শনিবার, ৯ আগস্ট, ২০১৪

হিরোসিমা: ইতিহাসের আর্তনাদ, বর্তমানের অনুপ্রেরণা

আকতার হোসেন: মাত্র একটা বোমা যে কীভাবে মুহুর্তের মধ্যে একটি শহরকে গ্রাস করে ফেলতে পারে তা বিশ্ববাসীর কাছে ছিল অজানা। এর ভয়াবহতা যে কী পরিমান তা ছিল চিন্তার বাইরে। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকালের স্নিগ্ধতায়  মানুষ প্রত্যক্ষ করলো পৃথিবী জুড়ে ক্ষমতার লড়াইয়ের চুড়ান্ত বিভৎসতা। ক্ষমতার লড়াই কতটুকু হিংস্র আর অমানবিক হতে পারে।


একটি মাত্র আনবিক বোমা  যার নাম ‘লিটল বয়’। সেই লিটল বয়ের বিষাক্ত ছোবলে ক্ষত বিক্ষত হয় জাপানের হিরোশিমা নগরী। এর মাত্র তিনদিন পরে নিক্ষেপ করা হয় "ফ্যাটম্যান" নামক দ্বিতীয় আনবিক বোমাটি। এটি ফেলা হয় নাগাসাকি শহরের উপর।  সেই রক্তস্নাত শোকাহত স্মৃতি আজো বিশ্বব্যাপী স্মরন হয় শোক আর বেদনার অভিব্যক্তিতে। যুগে যুগে যুদ্ধ বিরোধী প্রচার এবং আন্দোলনে হিরোশিমার সেদিনের ভয়াল স্মৃতিকে তুলে ধরা হয় যুদ্ধকে ঘৃনা জানাতে।

কী ঘটেছিল সেই দিন?

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা তখন জোরেশোরে বাজছে। জাপানের হিরোশিমা শহরে স্থানীয় সময় সকাল আটটা ১৫ মিনিট। ভয়ংকর নির্দেশটা আগেই দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান। বাকি ছিল শুধু বাস্তবায়ন। বোমারু বিমান ‘এনোলা গে’ বয়ে নিয়ে এল গণবিধ্বংসী সেই মারণাস্ত্র। হিরোশিমায় ফেলা হলো আণবিক বোমা ‘লিটল বয়’। মুহুর্তেই পুরে ছারখার হেয়ে যায় হিরোশিমা অঞ্চল। দেখে বুঝারই উপায় ছিলনাযে কয়েক মূহুর্ত আগেও এই শহরে মানুষ বসবাস করতো। কয়েক হাজার মানুষ সেদিন জীবন্ত পুড়ে মারা গিয়েছিল সেদিন। আনবিক বোমা হামলার সঙ্গে সঙ্গেই যে শুধু মানুষ মারা গেছে তা কিন্তু নয়৷ তেজস্ক্রিয়তা, শরীরের নানা অংশ পুড়ে যাওয়া এবং মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার কারণে ১৯৪৫ সালের শেষ নাগাদ মোট মৃতের সংখ্যা গিয়ে ঠেকে ৬০ হাজারে৷ অন্যদিকে নাগাসাকিতে মারা যান প্রায় ৮০ হাজার লোক।  আনবিক বোমা হামলার ভয়াবহতা শুধু তখনই গ্রাস করেনি বিশ্ব বাসীকে। বরং মানব জাতিকে এর জের টানতে হয়েছে বছরের পর বছর। বোমা নিক্ষেপের দুই থেকে চার মাসের মধ্যে বোমার তীব্র প্রতিক্রিয়ায় মারা যান প্রায় ১ লক্ষ ৬৬ হাজার লোক। পাঁচ বছর পর তা গিয়ে দাঁড়ায় ২ লক্ষ ৩০ হাজারে! এটম বোমার বিষ্ফোরণ জাপানের পরিবেশকে করেছিল মারাতœক বিষাক্ত। মোট কথা বিপর্যয় নেমে আসে হিরোসিমায়।

ইতিহাসের পাতায় হিরোসিমা আক্রমণ:

হিরোশিমাতে যে সময় আনবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয় সে সময় শহরটি শিল্প ও সামরিক দিক থেকে বিশেষ গুরুত্ববহন করছিল। হিরোশিমার কাছেই বেশ কিছু সেনা ছাউনি ও পঞ্চম ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার ছিল। শহরের মধ্যাঞ্চলে ছিল দালান ও হালকা ধরনের স্থাপনা। বাইরের দিকে ছিল ছোট ছোট কাঠের কারখানা ও জনবসতি। যুদ্ধের সময় হিরোশিমার জনসংখ্যা ৩ লক্ষ ৮১ হাজারে বৃদ্ধি পায়।
আনবিক বোমার পরে দ্রুত শহরটি খালি হয়ে যেতে থাকে। বোমা ছাড়াও এর অন্য একটি কারন সরকার কর্তৃক জনসাধারনকে শহর থেকে সরিয়ে নেয়া।

৬ই অগাষ্টের আনবিক বোমা নিক্ষেপের জন্য নির্বাচিত তিনটি শহরের একটি হচ্ছে হিরোশিমা। অন্য দুটি হচ্ছে কোকুরা ও নাগাসাকি। ৩৯৩ বোম্বার্ডমেন্ট স্কোয়াড্রনের অন্তর্ভুক্ত ছিল বি-২৯ এনোলা বে বিমানটি। যার চালক ও কমান্ডার ছিলেন ৫০৯তম কম্পোজিট গ্রুপ কমান্ডার কর্নেল পাউল টিব্বেটস। এনোলা গে উড্ডয়ন করে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় টিনিয়ান এয়ারবেস থেকে। জাপান পর্যন্ত উড়ে যাবার সময় হলো ছয় ঘন্টা।

পাইলট পাউল টিব্বেটস এর মায়ের নাম অনুসারে বিমানটির নাম দেয়া হয় এনোলা গে।

টিনিয়ান বেস থেকে উড়ে যখন টার্গেট অঞ্চলে পৌঁছায় তখন দৃষ্টিসীমা ছিল ৯ হাজার ৮৫৫ মিটার। বোমা নিক্ষেপের প্রায় একঘন্টা আগে জাপানের রাডার মার্কিন বিমানের আগমনী বার্তা সনাক্ত করতে সক্ষম হয়। বিমান হামলার সতর্কবাণী রেডিওতে প্রচার করা হয়। হিরোশিমা সহ অনেক শহরে রেডিও সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। সকাল ৮ টার দিকে হিরোশিমার রাডার অপারেটর মোট কয়টি আমেরিকান বিমান আসছে তা চিহ্নিত করেন। দেখা যায় বড়জোর তিনটি মার্কিন বিমান আসছে, কাজেই বিমান হামলার তেমন সম্ভাবনা নেই মনে করে বিমান হামলার সতর্কতা প্রত্যাহার করা হয়। এ দিকে জাপানী বিমানবাহিনীও তেল ও বিমান বাঁচাতে এই তিনটি মাত্র বিমানকে প্রতিহত করার চিন্তা বাদ দেয়।

হিরোশিমা সময় সকল ৮.১৫ মিনিটে পরিকল্পনা মাফিক ৬০ কিলোগ্রাম ওজনের ইউরেনিয়াম-২৩৫ সমৃদ্ধ লিটল বয় বিমান থেকে পড়ে। ৪৩ সেকেন্ড সময় নেয় শহরের ৫৮০ মিটার বা ১৯০০ ফুট উচ্চতায় আসতে। বোমা নিক্ষেপ করে ১১.৫ মাইল চলে আসার পর নিক্ষেপকারী বিমানটি বোমার শক ওয়েভ অনুভব করতে পারে।

সে সময় জোর বাতাস বইছিল, ফলে বোমাটি তার ঠিক লক্ষ্য আওই ব্রিজে পৌঁছাতে ব্যার্থ হয় এবং ২৪০ মিটার পাশে সরে গিয়ে শিমা সার্জিক্যাল ক্লিনিকের উপর বিস্ফোরিত হয়। ১৩ কিলোটন টিএনটির সমপরিমান বিস্ফোরন ঘটে। প্রায় ১২ বর্গকিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকা সম্পূর্ণ ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। জাপানের প্রদত্ত হিসেবে মতে হিরোশিমার ৬৯% ভাগ দালান পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়।

সাথে সাথেই নিহত হয় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ, আরো ৭০ হাজার পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যে মারা যান। হিরোশিমা শহরের ৯০% ডাক্তার, ৯৩% নার্স বোমায় নিহত হন। ১৯৫০ সালের মধ্যে আনবিক বোমায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লক্ষে। ক্যান্সার সহ নানান প্রতিক্রিয়ায় তাদের মৃত্যু হয়।

হিরোশিমার বর্তমান অবস্থা


১৯৪৯ সালে হিরোশিমা শান্তি স্মৃতি পার্ক নির্মান করা হয়, হিরোশিমা চৎবভবপঃঁৎধষ শিল্প উন্নয়ন হল, পষড়ংবংঃ বোমা বিস্ফোরণ এর স্থানে জীবিত ভবন, এবহনধশঁ অট্টালিকা বা পরমাণু অট্টালিকা , হিরোশিমা শান্তি স্মৃতি জাদুঘর ১৯৫৫ সালে নির্মান হয়।







হিরোশিমা ১৯৪৯ সালে জাপানি পার্লামেন্ট দ্বারা শান্তি শহরের ঘোষিত হয়। হিরোশিমা উপসাগরকে ঝিনুকের আঁধার বলা হয়। সরকার আর জনগনের চেষ্টায় এই শহর এখন হয়ে শান্তি আর উন্নয়নের নগরী। একটি বিধ্বস্ত দেশ থেকে কীভাবে উন্নয়নের নগরীতে পরিণত হওয়া যায়, বর্তমান হিরোসিমা তারই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। তাই বর্তমান হিরোসিমা এখন বিশ্বের অনুপ্রেরণা।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন