বুধবার, ২৩ জুলাই, ২০১৪

হিটলার ইহুদীদের প্রতি এত ক্ষিপ্ত ছিলেন কেন? পর্ব-১


অ্যাডলফ হিটলার। অবশ্য শুধু হিটলার হিসেবেই বিশ্বব্যাপী অধিক পরিচিত তিনি। ইতিহাসের পাতায় এক নিষ্ঠুর শাসক ও ভয়ানক খুনি হিসেবেই তার কুখ্যাতি। তবে, হিটলারের হিটলিস্টে যারা পরপারে যাত্রা করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল ইহুদী সম্প্রদায়ের লোকেরা।

গত অর্ধশতাব্দিরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের শান্ত ভূমিতে অশান্তির দাবানল সৃষ্টিকারী এবং অসংখ্য নারী-পুরুষ ও মাসুম শিশুর রক্তে যাদের হাত রঞ্জিত সেই ইহুদীদের প্রতি হিটলার কেন এত বিরাগভাজন ছিলেন? কেন লাখ লাখ ইহুদীকে নির্মমভাবে হত্যার পর তিনি আবার সদর্পে ঘোষণা দিয়েছিলেন-আমি ইচ্ছা করলে সব ইহুদীদের হত্যা করতে পারতাম, কিন্তু কিছু ইহুদী রেখে দিলাম যাতে পরবর্তী প্রজন্ম বুঝতে পারে কেন আমি তাদের হত্যা করেছিলাম।

হিটলারের এই ধরনের দম্ভোক্তি হয়তো এতদিন মানুষের কাছে তার হিংস্রতারই বহি:প্রকাশ হিসেবেই প্রতিভাত হতো। কিন্তু গত কয়েক দশকে যায়নবাদী ইসরাইলিরা ইহুদীবাদ সম্প্রসারের নামে যেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও তান্ডবের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে, তাতে অনেকেই এখন আগ্রহী হয়ে উঠেছেন হিটলারের ইহুদী বিদ্বেষের আদ্যপান্ত জানতে। খলনায়ক থেকে হিটলারকে অনেকেই এখন মহানায়ক ভাবতে শুরু করেছেন।

ইহুদীদের মতো এমন একটি বর্বর জাতিকে যেই মহামানব ধ্বংস করে পৃথিবীকে অশান্তির হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন সে আর যাই হোক অতটা খারাপ নয়-এমন ধারনাও এখনকার প্রজন্মের অনেকেই পোষণ করে থাকেন।

যাই হোক আজকের আলোচনার বিষয় এটি নয়। এই বিতর্কিত বিষয় নিয়ে গবেষণা চলতে থাকুক। হয়তো একদিন আসল সত্য প্রকাশ পাবে। কারণ ইতিহাস কখনো চাপা থাকে না। কোন না কোনভাবে আসল সত্য এক সময় প্রকাশ করাই ইতিহাসের ধর্ম।

এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। আর সেটি হলো হিটলার ইহুদীদের সম্পর্কে আসলে কী বলে গেছেন? ইহুদীদের প্রতি তিনি কেন এত ক্ষিপ্ত ছিলেন? এত বিশাল সংখ্যক ইহুদীকে হত্যা করার পরও সামান্যতম অনুশোচনায় না ভুগে কেন হিটলার তার এই কাজকে বরং ইতিবাচক হিসেবে প্রচার করেছেন?

১৯২৪ সালে মিউনিখ গণআদালতে বিচার চলাকালে লেখ নদীর তীরবর্তী ল্যান্ডসবার্গের দুর্গে হিটলারের কারাজীবন শুরু হলে সেখানেই তিনি লিখেছিলেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ "মাইন ক্যাম্পফ" (Mein Kampf)। এই বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় তিনি ইহুদীদের সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন সেগুলোকে পর্যায়ক্রমে সাজিয়েই টাইমনিউজবিডির পাঠকদের জন্য তৈরি করা হলো এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন। জার্মান ভাষায় লিখিত হিটলারের মাইন ক্যাম্পফ বইটির ইংরেজী অনুবাদ করেছেন জেমস মারফি।

ইহুদীদের প্রতি হিটলারের মনে যে প্রচন্ড ঘৃনা ও বিদ্বেষের জন্ম হয়েছিল তা কোন ধরনের উগ্র চিন্তা বা অন্যায়বোধ থেকে জন্মলাভ করেনি বলেও বইয়ের বিভিন্ন স্থানে যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন হিটলার। তিনি ইতিহাস সম্পর্কে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। ছোটবেলা থেকেই ইতিহাস পাঠ করে এবং সচেতনভাবে ইহুদীদের কুটকৌশল দেখতে দেখতে বিবেকের তাড়না থেকেই ইহুদীদের দমনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছিলেন হিটলার।

হিটলার তার বইয়ের একেবারে প্রথম দিকে “In the Home of My Parents” অর্থাৎ “বাবা-মায়ের সঙ্গে বাড়ির দিনগুলো”-এমন শীরোনামের অধ্যায়ে লিখেছেন “To study the history means to search for and discover the forces that are the causes of those results which appear before our eyes as historical events. The art of reading and studying consists in remembering the essentials and forgetting what is not essentials”.

অনুবাদ করলে এর মর্মার্থ দাঁড়ায়-“ইতিহাস অধ্যয়নের প্রকৃত অর্থ হলো ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা হিসেবে আমাদের চোখের সামনে যেসব ঘটনা আসে সেগুলোর পেছনের মূল শক্তিকে খুঁজে বের করা এবং এর কারণ ও ফলাফল আবিস্কার করা। পাশাপাশি ইতিহাস পাঠের সর্বোত্তম কৌশল হলো প্রয়োজনীয় বিষয়টাকে মনে রাখা এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয়টাকে ভুলে যাওয়া”।

শুধু ইতিহাসই নয় জীবনের প্রতিটি বাঁক সম্পর্কেও হিটলারের উপলব্ধি ছিল অসাধারণ। সেই ছোট বেলা থেকেই হিটলার জীবনকে একেবারে নিজের মতো করে উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন। কারো চাপিয়ে দেয়া কিছু তিনি সহজে মেনে নিতে পারতেন না যদি না সেটি তার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হতো।

আর এ কারণেই মাত্র এগারো বছর বয়সেই তিনি নিজের বাবার মতের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু এটা আলোচনার বিষয় না হওয়ায় এ ব্যাপারে বেশি আলোচনা না করে শুধু হিটলারের একটি উক্তি তুলে ধরা যাক। বইয়ের একই অধ্যায়ের শেষের দিকে হিটলার লিখেছেন, “I respected my father but I loved my mother” অর্থাৎ “বাবাকে শ্রদ্ধা করতাম, কিন্তু মাকে ভালোবাসতাম”।

এ অধ্যায়ে হিটলার আরও লিখেছেন, “For the first time in my life- I was then eleven years old- I felt myself forced into open opposition. No matter how hard and determined my father might be about putting his own plans and opinions into action, his own son was no less obstinate in refusing to accept ideas on which he set little or no value.”

সরল অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়ায়, “আমার মধ্যেও প্রচন্ড জেদ। জীবনে প্রথমবারের মতো বাবার মতামতকে অগ্রাহ্য করলাম সেই ১১ বছর বয়সে। ভয় অথবা স্নেহ কোন কিছুই আমাকে বিচ্যুত করতে পারলো না আমার সিদ্ধান্ত থেকে”।

“Years of Study and Sufferings in Vienna” অর্থাৎ “অধ্যয়ন ও ভিয়েনায় যন্ত্রনাময় বছরগুলো”-এই শিরোনামে বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে হিটলার তৎকালীন সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে লিখেছেন, “Here there is no place for merely social activities and that there can be no expectation of gratitude; for in this connection there is no question at all of distributing favors but essentially a matter of retributive justice”.

অর্থাৎ “সামাজিক কর্মকান্ড বলতে যা বুঝায় তার কোন স্থান সেখানে ছিল না এবং কৃতজ্ঞতা নামক বিষয়টি সমাজের বুক থেকে মুছে গিয়েছিল। সমাজের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা করাটাই ছিল বৃথা। সত্যিকার অর্থে প্রাপ্য যদি কিছু থাকে, তা ছিল অন্যায় বিচার”।

বইয়ের একই অধ্যায়ে হিটলার আরও লিখেছেন, “At that time it was for the most part not very difficult to find work, because I had to seek work not as a skilled tradesman but as a so-called extra-hand ready to take any job that turned up by chance, just for the sake of earning my daily bread…filled more and more with the idea that honest work never disgraced anybody, mo matter what kind it may be.”

অর্থাৎ “সে দিনগুলোতে আমার পক্ষে কাজ যোগাড় করা কঠিন হলেও অসম্ভব ছিল না। কারণ দক্ষ শ্রমিকরা যে কাজ করেন সেই কাজই আমাকে যোগাড় করতে হবে এমন কোন কথা নেই। বরং কুলি-কামারের মতো কাজ, যেগুলোতে অনেকেরই আগ্রহ নেই, পেটের তাগিদে আমি সেগুলোই করতাম...কোন কাজ কাউকে ছোট করতে পারে না, যদি তা সততার সাথে সম্পন্ন করা যায়”।

এভাবেই জীবনের প্রতিটি বাঁকে নিজস্ব উপলব্ধি আর ইতিহাসের গভীরে প্রবেশ করে বাস্তব সত্য অনুধাবন থেকেই হিটলারের ইহুদী বিদ্বেষের জন্ম। আর এটা যে কতটা বাস্তব ছিল তা বর্তমান সময়ের প্রতিটি সচেতন মানুষ স্বচক্ষে দেখে উপলব্ধি করতে পারছেন।

তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইপ এরদোগান বলেছেন, ইসরায়েল জার্মানির নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলারের চেয়েও বর্বর। শনিবার (১৯ জুলাই ২০১৪) তুরস্কে এক নির্বাচনী সমাবেশে এমন মন্তব্য করেন তিনি।

বাবা মা দুজনকেই হারিয়ে চরম দারিদ্রের মধ্যে যখন হিটলারের দিনগুলো কাটছিল, তখনও তার উপলব্ধিতে এতটুকু ঘাটতি হয়নি। বরং ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দেশ-জাতির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে উপলব্ধিটা যেন আরও শানিত হচ্ছিল। মাত্র ১৬ বছর বয়সে হিটলারের সেই সময়কার অনুভূতি তিনি ব্যক্ত করেছেন তার বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে।

“Years of Study and Sufferings in Vienna” অর্থাৎ অধ্যয়ন ও ভিয়েনায় যন্ত্রনাময় বছরগুলো”-এই শিরোনামে হিটলার আরও লিখেছেন “It was during this period that my eyes were opened to two perils, the names of which I scarcely knew hitherto and had no notion whatsoever of their terrible significance for the existence of the German people. These two perils were Marxism and Judaism”.

সরল অনুবাদ করলে দাঁড়ায়-“এ সময় জার্মান জাতির জন্য হুমকিস্বরুপ দুটো বিষয় আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটি হলো মার্কসইজম এবং অন্যটি হলো জুডোইজম বা ইহুদীবাদ”।

বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় তিনি মার্কসইজমের নানা অসঙ্গতি অত্যন্ত বাস্তবিকভাবে তুলে ধরেছেন। চলমান সমাজের নানা ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে পেশ করে তার সাথে ইতিহাসের যোগাযোগ স্থাপন করে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে তিনি মার্কসবাদের নেতিবাচক দিকগুলো দেখিয়ে দিয়েছেন। তবে এই প্রতিবেদন যেহেতু ইহুদীদের প্রতি হিটলারের দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে। তাই মার্কসইজম বিষয়ে হিটলারের মনোভাবের বিষয়টি আলোচনা করার অবকাশ নেই।

হিটলার তার বইয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে ইহুদীরা সুকৌশলে মানুষকে যুগের পর যুগ ধোকা দিয়েছে। কিভাবে যায়নবাদী ইসরাইলিরা হলুদ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে মানুষকে প্রকৃত সত্য থেকে বিমুখ রেখেছে এবং মিথ্যার বেসাতি দিয়ে কিভাবে পুরো বিশ্ববাসীকে নাস্তানাবুদ করেছে। বইয়ের বিভিন্ন স্থানে হিটলারের ইহুদীদের নিয়ে লেখা এমন তথ্যগুলোই পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হবে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদনে। ধারাবাহিকের প্রথম পর্বের এখানি সমাপ্তি টানা হলো। (-কামরুজ্জামান বাবলু )

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন