ছবির মতোই সুন্দর ছিল আমার গ্রামটা...

বর্ষা মৌসুমে নৌকা ছাড়া চলাচলের কোন উপায় থাকতোনা। যেন মহসড়কের পাশে বিচ্ছিন্ন ছোটএকটা দ্বীপ।

সমস্যা যত বড়ই হোক, আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে

আমরা অবশ্যই পারব৷ সমস্যা যত বড়ই হোক না কেন, আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে অনুপ্রেরণা জোগায়৷ কিন্তু সমস্যাকে নিজের চোখে না দেখলে শুধু আশা দিয়ে সমস্যা সমাধান করা যায় না৷

ঘুরে আসুন নারায়ণগঞ্জের সব দর্শনীয় স্থানে

অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি জেলায়ই রয়েছে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। যা আমাদের দেশকে করেছে আরো সমৃদ্ধ। শত বছর ধরে লাখো পর্যটককে করেছে আকৃষ্ট।

মানবসেবাই সর্বোত্তম ধর্ম: ফাদার তেরেসা

অসহায়, দুস্থ মানুষের সহায়তাই তার ধ্যান-জ্ঞান।সহিংসতার বিপরীতে তিনি অসহায়ের ত্রানকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন।তিনি পাকিস্তানের আবদুল সাত্তার ইদি।অসম্ভব মানবসেবার কারনে ৮৪ বছর বয়সী এই ব্যক্তি তার দেশে ফাদার তেরেসা নামেই বেশি পরিচিত।

‘মানসিক প্রশান্তির জন্য সাইকেল’

যাত্রা পথে পরিবহন নিয়ে দুশ্চিন্তা আর ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে বিকল্প হলো একটা বাই সাইকেল। তাছাড়া ইদানিং স্বাস্থ্যটার দিকেও মনে হচ্ছে একটু যত্ন নেয়া দরকার।

বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

বিশ্বের শীর্ষ ধনীরা পড়েছেন যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে

মানুষের মতো মানুষ হওয়া এখনো শিক্ষা লাভের প্রধানতম উদ্দেশ্য। তবে শিক্ষালাভ করে আজকাল শুধু ভাল মানুষ হলেই চলে না, সঙ্গে জীবিকাও নির্বাহ করতে হয়। আর তাই শিক্ষা লাভের সঙ্গে বর্তমানে জীবিকা নির্বাহের সম্পর্ক একসূত্রে গাঁথা। এ কারণে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়লে ভাল চাকরি পাওয়া যায় সেগুলোতে পড়ার চাহিদাও বেশি।

বিশ্বের বেশিরভাগ কোটিপতি পড়াশুনা করেছেন এমন কিছু বিশ্ববিদ্যারয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স ও সুইজারল্যান্ডের ইউবিএস ব্যাংক।

তালিকায় স্থান পাওয়া ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টিই যুক্তরাষ্ট্রের। বর্তমানে বিলিয়নিয়ারের তালিকায় থাকা ২০৮ জন ধনকুবের এক সময় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। ভারত, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও সুইজারল্যান্ডের একটি করে বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে এ তালিকায়।

তালিকার প্রথম ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় হলো- যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড, ইয়েল, সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া, প্রিন্সটন, কর্নেল, স্ট্যানফোর্ড ও ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে ইউনিভার্সিটি।

প্রথমবারের মতো তালিকায় স্থান করে নেওয়া ভারতের মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৯ নম্বরে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ১২ জন সাবেক শিক্ষার্থী এখন বিশ্বের শীর্ষ একশ' ধনীর তালিকায় রয়েছেন। ভারতের সবোর্চ্চ ধনী ও রিয়ালেন্স গ্রুপের কর্ণধার মুকেশ আম্বানি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।

তালিকায় ১০ নম্বরে রয়েছে যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স।

কোটিপতি তৈরিকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করলেও কোটিপতি হওয়ার জন্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণ পূর্বশর্ত নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ বিশ্বের মোট বিলিয়নিয়ারের ৩৫ শতাংশেরই স্নাতক ডিগ্রি নেই। এদের অনেকে আবার স্কুলের গণ্ডিই পেরুতে পারেন নি।
তাই কোটিপতি তৈরির এসব 'আতুরঘরে' পড়তে না পারলেও আপাতত হাতাশার কিছু নেই।

বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

এক কামরার ঘর (অনুবাদ গল্প)

ইউসুফ ইদ্রিস (জন্ম:১৯২৭, মৃত্যু:১৯৯১) আরবী ভাষার সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে অন্যতম একজন। মিশরীয় এই ছোট গল্পকার ও নাট্যকার পেশাগত জীবনে একজন চিকিৎসক ছিলেনকট্টর বামপন্থী এই লেখক তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের কারণে জেলও খেটেছেনতাঁর লেখায় সমন্বয় ঘটেছে প্রচলিত আখ্যানরুপের সঙ্গে চলিত কথনের, ফুটে উঠেছে সাধারণ গ্রাম্য জীবনের বাস্তবতাঅনুদিত ‘A House of Flesh ‘ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের এক গল্প সংকলনেমোনা মিখাইলের ইংরেজী অনুবাদ অনুসরণে লেখাটি বাংলায় তর্জমা করেছেন রেশমী নন্দী। 

নিস্তব্দতা নিয়ে এ গল্প শুরুপঁয়ত্রিশ বছর বয়সী লম্বা, ফর্সা, লাবণ্যময়ী এক বিধবা আর তাঁর তিন মেয়ে, গড়নে লম্বা তবে মোটা গোছেরদিনের পর দিন, অনেকদিন তারা সবাই ক্রমাগত কালো রঙের শোকের পোশাক পরে আছেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটজনের বয়স ষোল আর বড়জন বিশের কোঠায়বাবার মতোই মেয়েরা সবাই কালো, বিসদৃশ দেহাবয়বধারি, স্থুলকায়, থলথলে- মায়ের গড়নের প্রায় কিছুই পায়নি তারাসারাটা দিন এক কামরার বাসাতেই তাদের দিন কাটেচরম অভাবের মধ্যেও মেয়েলি ছোঁয়ার গুণে তাদের এক কামরার ঘরটা ছিমছাম, আরামদায়করাত নেমে এলে এ ঘরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে চারটা শরীরবিছানায়, আরামকেদারায় গড়াগড়ি খেতে থাকে উষ্ণ জীবন্ত মাংসের পিন্ডগুলো- ঘুমহীন রাত ঘন নিঃশ্বাসের শব্দে ভারী হয়ে ঝুলে থাকে ঘরে

দীর্ঘ রোগভোগের পর এ বাড়ির একমাত্র পুরুষ সদস্য মারা যাওয়ার পর থেকেই শব্দহীনতায় ডুবে আছে এ ঘর, তবে সেও প্রায় দুবছর হলোশোকের বাঁধা সময় পার হয়েছে অনেক আগেই, কিন্তু শোক করার অভ্যাস কাটেনি, বিশেষ করে চুপচাপ থাকার এ প্রবণতাআদপে এ একধরনের প্রতীক্ষামেয়েদের বয়স বাড়ছে কিন্তু কোন পাণিগ্রাহী এ পথ মাড়াচ্ছে নাকে-ই বা দেখতে খারাপ, সেই সাথে এতিম এমন মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে? কিন্তু আশা মরে না (সঠিক ক্রেতার জন্য সুরার অপেক্ষা স্বতঃসিদ্ধ)মেয়েরা আশা করে বসে আছে একদিন ভাগ্য বদলাবেতারা যতই গরীব হোক, তাদের চেয়েও গরীব নিশ্চয় কেউ আছেআর চেহারার কথাই যদি ধরা হয়, তাদের চেয়েও কুৎসিত মানুষের অভাব নেইসবচেয়ে বড় কথা, ধৈর্য্য ধরলে স্বপ্ন একদিন পূরণ হবেই

স্থায়ী এ নৈঃশব্দ ভেঙ্গে মাঝে মাঝে আবেগহীন একঘেয়ে গলায় এ বাড়িতে কোরান তেলাওয়াতের সুর শোনা যায়অন্ধ এক তেলাওয়াতকারী মৃতের আত্মার বেহেস্তবাস কামনা করে প্রার্থনা করেপ্রত্যেক শুক্রবার তার লাঠি এ বাড়ির দরজায় আওয়াজ তোলেকেউ একজন তখন হাত বাড়িয়ে তাকে ভিতরে নিয়ে আসেমাদুরে হাঁটু মুড়ে বসে শুরু হয় কোরান তেলাওয়াতপ্রার্থনা শেষে হাতড়ে হাতড়ে জুতা জোড়া খুঁজে নিয়ে সালাম জানিয়ে বিদায় নেয় সেকেউ তাকে স্বাগত কিংবা বিদায় জানায় নাঅভ্যাসবশতঃ সে আসে, কোরান পাঠ করে আর চলে যায়তার উপস্থিতি পর্যন্ত কেউ লক্ষ্য করে না
flesh.gif
এ ঘরের অনতিক্রম্য নৈঃশব্দ কোরানের সুরেও বিচলিত হয়নাসম্ভবতঃ কেবল নীরবতার চাপেই চেপে বসা নীরবতার অবসান সম্ভবঅপেক্ষা আশার মতোই চিরন্তনতুচ্ছ মানুষও বাঁচে নিয়ত আশায়, তা যতই অকিঞ্চিতকরই হোক না কেনতুচ্ছের চেয়েও তুচ্ছতর কেউ না কেউ থাকেইআর মেয়েদের স্বাভাবিক এ চাওয়াকে উচ্চাকাঙ্খা বলা যায় না

এভাবেই দিন কেটে যেত যদি না সেই শুক্রবারও অন্ধ তেলাওয়াতকারী যথারীতি এ বাসায় আসতোসব কিছুরই শেষ আছে, দেখা যাচ্ছে এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছেসেদিনই প্রথমবারের মতো মা ও মেয়েরা বুঝতে পারলো, সপ্তাহের অন্তত একটা দিন একজন পুরুষের গলা এ বাড়িতে শোনা যেত এতদিনআর এরমধ্যে এ লোকই একমাত্র পুরুষ যে এ বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়েছেতাদের হঠাৎ বোধদয় হলো যে গরীব হলেও তার পরিচ্ছন্ন পোশাক, চকচকে জুতা আর নিখুঁত পাগড়ির বাঁধন যেকোন দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষকে লজ্জা দিতে পারেআর তার চেয়েও বড় কথা, তার আছে তেজদীপ্ত, গভীর, সুরেলা কন্ঠস্বরতাদের মনে হতে থাকলো যে এখনই তাকে ডেকে এনে চুক্তি নবায়ন করা উচিৎতিনি কি অন্য কোথাও ব্যস্ত থাকবেন? সে যাই হোক, তারা অপেক্ষা করতে পারবেঅপেক্ষা করার অভ্যাস তাদের আছে

সন্ধ্যা শেষ হয়ে এসেছেতিনি কোরান পাঠ করছেন যেন প্রথমবার তারা শুনছেতারা ভাবতে শুরু করলো, যার গলার স্বর এ ঘর ভরিয়ে রাখে, তাদের মধ্যেই কারো একজনের তাকে বিয়ে করে ফেলা উচিৎ

সদ্য গোঁফ উঠা অবিবাহিত এক যুবক তিনিকথায় কথায় জানা গেছে তিনিও বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রীর সন্ধানে আছেনমেয়েদের আলোচনা থেকে এ কথা জেনে মা মেয়েদের মুখের দিকে তাকায়বোঝার চেষ্টা করে, এদের মধ্যে ভাগ্যবান কোনজন? কিন্তু মায়ের চোখে চোখ না রাখা চেহারাগুলো যেন বলতে থাকে, “আমাদের দীর্ঘ প্রতিক্ষার এই কি প্রতিদান? আমাদের এতদিনকার অপেক্ষার প্রাপ্তি একজন অন্ধ পুরুষ?” তারা তখনো স্বপ্ন দেখছিলো সত্যিকারের একজন স্বামী পাওয়ারআর স্বামী মানেই দৃষ্টিসম্পন্ন যুবকবেচারা, তাদের এখনো পুরুষদের জানতে বাকি আছেতাদের পক্ষে এই বয়সে বোঝা সম্ভব নয় যে কেবলমাত্র চোখের আলো থাকাটাই একজন পুরুষের যথেষ্ট যোগ্যতা নয়

মা, তুমি উনাকে বিয়ে করো
আমি? কি লজ্জা! লোকে কি বলবে?”
যার যা ইচ্ছে বলুকএকেবারে অভিভাবকহীন ঘরের চেয়ে ঢের ভালো এমন এক ঘর, যেখানে অন্তত পুরুষকন্ঠ বাজে
তোদের ফেলে আমি বিয়ে করবো? অসম্ভব
সেটাই তো ভালো হবেএরপর আরো অনেক পুরুষদের এ বাসায় আসার সুযোগ হবেআমাদেরও তখন বিয়ে হবেউনাকে তুমি বিয়ে করো মাও মা, বিয়ে করো উনাকে

তারপর, তাদের মা বিয়ে করলোএক কামরার ঘরে আরো একজনের নিঃশ্বাস যুক্ত হলোপরিবারের আয় কিছুটা বাড়লেও এবার বড় এক সমস্যা দেখা দিলোপ্রথম রাত কোনভাবে পার হলো কিন্তু ভুল করেও নবদম্পতি কাছাকাছি হলো নাযদিও মেয়েরা ঘুমিয়ে ছিলো কিংবা ঘুমের ভান করে ছিলো, কিন্তু মা স্পষ্ট টের পেল কয়েক জোড়া চোখ তাদের মধ্যকার দূরত্ব মাপছপুরো অস্তিত্ব দিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা চলছে এখানেদাম্পত্য সম্পর্কের মানে বোঝার পক্ষে মেয়েরা যথেষ্ট বড় হয়েছেহঠাৎ করেই পুরো ঘরটা যেন সংবেদনশীল কিছু একটাতে পরিণত হয়েছেযেন রাতের অন্ধকারেও পুরো ঘর আলোকিত

সকালবেলা এক এক করে মেয়েরা ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলোসন্ধ্যা নামতেই এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে ইতঃস্তত পায়ে ঘরের কাছাকাছি আসতেই তারা শুনতে পেলো, তাদের ফেলে যাওয়া ঘরজুড়ে হাসি, মাঝে মাঝে অস্পষ্ট মেয়েলি কন্ঠ শোনা যাচ্ছেনিশ্চয় মা আর তাদের সেই চেনাজানা সম্মানিত তেলাওয়াতকারীমেয়েদের দেখে মা তাদের দিকে এগিয়ে এলো- ভেজা খোলা চুল, হাতে ধরা চিরুনি, তখনো হাসছিলোতারা মায়ের মুখের দিকে তাকায়যেন অনেকদিন ধরে নিভে থাকা এক প্রদীপ, যার কোনায় ঝুল জমেছিলো, এখন আলোকিতজ্বলজ্বলে চোখে হাসির আভাসেদিন থেকে তাদের জীবন থেকে নিস্তব্দতা নির্বাসিত হলোরাতের খাবার সময়টা হৈ হৈ করে কাটলোতেলাওয়াতকারী তার সুরেলা কন্ঠে উম্মে কুলসুম ( হযরত মোহাম্মদের চার মেয়ের তৃতীয়জন ) আর আব্দুল ওহাবের ( ইসলামি শিক্ষাবিদ) অনুকরণ করে শুনিয়ে তাদের সবাইকে একেবারে মাতিয়ে রাখলো

এই তো চাইখুব শীঘ্রি এই হাসির শব্দ, এই ফূর্তি অন্য পুরুষদেরও আকর্ষন করবে
বিশ্বাস রাখো মেয়েরাখুব তাড়াতাড়ি পুরুষদের আগমন শুরু হবে আর বিবাহপ্রার্থীদের আগ্রহও প্রকাশ পাবেকিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মায়ের মন তখন ডুবে ছিলো যুবক স্বামীর স্বপ্নেলোকটা অন্ধ, কিন্তু চোখ থাকতেও তো আমরা প্রায়ই অন্যদের দিকে তাকাই নামানুষটার উপচে পড়া প্রাণশক্তির জোয়ার মায়ের এতবছরের অসুস্থতা, পুরুষত্বহীনতা আর অকাল বার্ধক্যের স্মৃতি ভাসিয়ে দিয়েছে

নিস্তব্দতাকে নির্বাসিত করে জীবনের স্পন্দন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক কামরার এ বাসায়
ধর্মমতে তাদের বিয়ে হয়েছে, তারা এখন বৈধ স্বামী-স্ত্রীএখন আর কিছুই মাকে লজ্জিত করে নাকোন কিছুই গোপন নয়, তেমন চেষ্টাও নেইএক কামরার বাসায় রাত নেমে আসে, গাদাগাদি করে এক কামরাতেই সবকটা মানুষএকসময় শরীরের দাবিতে দম্পতির শরীর আর আত্মার মিলন ঘটেহয়তো মেয়েরা তখন সজাগ নিদ্রায় অস্বিস্তহীন, দীর্ঘনিঃশ্বাস আর গোঙ্গানি চাপার চেষ্টা করছে

মায়ের দিন কাটে বড়লোকদের বাড়িতে কাপড় কেচে, মায়ের স্বামী দিনমান গরীবলোকদের ঘরে ঘরে কোরান তেলাওয়াত করে

প্রথম দিকে দুপুরবেলা লোকটা বাসায় ফিরতো নাকিন্তু রাতের ক্লান্তি কাটাতে, রাতের জন্য প্রস্তুত হতে ইদানিং তার বিশ্রাম নেবার দরকার হয়

দম্পতির কয়েকটা রাত আনন্দে কেটে গেলোএকরাতে হঠাৎ লোকটা জিজ্ঞেস করলো, দুপুরবেলা তার কি হয়েছিলোএখন এত কথা বলছে অথচ দুপুরে একেবারে চুপচাপ ছিলো কেন? এখন বিয়েতে উপহার দেয়া আংটি পড়েছে অথচ দুপুরে ওটা হাতে ছিলো না কেন?

এমন হতে পারতো যে একথা শোনা মাত্র মা উন্মাদের মতো চেঁচিয়ে উঠেছে, কান্ডজ্ঞান হারিয়ে লোকটাকে খুন করেছেকারন, যা সে শুনলো, এর কেবল একটি অর্থই হতে পারেনির্মম, ভয়াবহ এক অর্থকিন্তু একটা ঢোক গিলে উন্মত্ত কান্না ঠেলে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেকে শান্ত করে রাখলো সেঅন্ধকারে কান দিয়ে হাসিল করতে চাইলো শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কাজ, বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো, কে সেই অপরাধী? কেন যেন মনে হচ্ছে, এ মধ্যম জনের কাজভয়ঙ্কর ধারালো হয়ে উঠেছে ইদানিং ওর চোখতবু মা নিশ্চিত হবার জন্য কান পেতে থাকলোতিন মেয়ের ঘন ভারি নিঃশ্বাসের অনিয়মিত শব্দ টের পাওয়া যাচ্ছেযৌবনের স্বাভাবিক আকাঙ্খা গোঙানির শব্দে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, যেন আগুনের হল্কা, যেন উত্তপ্ত লাভা বেরিয়ে আসবে তৃষ্ণার্ত ভূমি ফুঁড়েমায়ের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, গলায় ঠেকছে একটা কান্নার ডেলানিজের সন্তানদের মা এখন আর আলাদা করে চিনতে পারছে না- সবকটা মানুষি একাকার হয়ে গেছে কামনার উত্তাপেসবারই শরীর জুড়ে ক্ষুধাসন্তানদের নিঃশব্দ এ বিলাপ হাহাকার নয়, যেন মায়ের কাছে আকুতি, সানুনয় প্রার্থনা কিংবা হয়তো তারও চেয়ে বেশি কিছু


এতদিন মা নিজের ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্তিতে মগ্ন থেকেছেসন্তানদের প্রতি দায়িত্বের কথা তার মনে ছিলো নাতার মেয়েদের কাছে অপেক্ষা এখন তেতো লাগছে, পরিণয় আকাঙ্খা মরিচীকার মতো উবে গেছেহঠাৎ করেই যেন মার খেয়ে কিংবা ভেতরের গোপন কোনো ডাকে ওরা জেগে উঠেছেআকাঙ্খার বস্তু নিষিদ্ধ কিন্তু আকাঙ্খা যে এখানে আরো বড়ো পাপএ ক্ষুধাকে মা খুব ভালো করে চিনেকতদিন আত্মার উন্মিলনে রক্তেমজ্জায় এ ক্ষুধা নিজেকে জাহির করেছে তার কাছেযে তৃপ্তি নিয়ে সে এখন পূর্ণ, তাকে ভোলা তো তার পক্ষে অসম্ভব

ক্ষুধার্ত সন্তান! মা হিসেবে নিজের মুখের খাবার তুলে দিয়ে সারাজীবন সন্তানদের ক্ষুধা মিটিয়েছে সে, নিজের কথা তো কখনো ভাবেনিআর আজ? সে যে মা, একথা কি করে ভুলে যাবে সে?

এরপর সেই রাতে আর কোনো অনুরোধই তাকে জাগাতে পারলো নাবেদনা জমাট বেঁধে পরিণত হয়েছে নিস্তব্দতায়মা সেদিন থেকে একেবারে চুপচাপ হয়ে গেলোপরেরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে দেখা গেলো ঠিক তার ভাবনানুযায়ি মেজো মেয়েও চুপচাপমা আর মেয়ে এরপর থেকে নিস্তব্দতাতেই আশ্রয় নিলোরাতে খাবার সময় অন্ধ কর্তা খুশিতে ডগমগ, গান গাইছে, হাসছে, কিন্তু আজ কেবল বড় আর ছোট মেয়ে এ আনন্দের সাথে তাল মিলালো

ধৈর্য্য পরীক্ষার তিক্ততা অসুস্থ করে তুলেছে মেয়েদের কিন্তু তখন পর্যন্ত কোন পাণিপ্রার্থির দেখা নেইএকদিন হঠাৎ বড় মেয়ে মায়ের বিয়ের আংটির দিকে তাকিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেমায়ের হৃদয় কেঁপে উঠলোহৃদস্পন্দনের তুমুল ডামাডোলের ভিতর দিয়ে মা শুনতে পেলো, বড় মেয়ে কেবল একটা দিনের জন্য তার কাছে আংটিটা চাইছেমা চুপচাপ আংটিটা খুলে মেয়ের হাতে দিয়ে দেয়মেয়েও আর কোন কথা না বলে আংটিটা হাতে পড়ে নেয়

সেই সন্ধায় বড় মেয়েও একেবারে চুপচাপ হয়েছিলোএবং সেদিন অন্ধ কর্তার আনন্দ হুল্লোড়ে কেবল ছোট মেয়েকেই আগ্রহী দেখা গেলো

অপেক্ষা করতে করতে ছোট মেয়েটাও বড় হয়ে উঠলো কিন্তু ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হলেন নাএবং একদিন এ খেলায় যখন সে নিজের জায়গা চাইলো, তখন কোথাও কোন আলোড়ন না তুলেই সে এর অংশ হয়ে গেলো

আংটিটা প্রদীপের পাশেই পড়ে থাকেচারপাশ চুপচাপকান পর্যন্ত কিছু জানতে পারে নাএর মধ্যে যখন যার পালা আসে আংটিটা হাতড়ে নিয়ে আঙুলে ঢুকিয়ে নেয়আর তারপর আলোটা নিভে যায়

অন্ধকারের রাজত্বে দৃষ্টিবানরাও অন্ধে পরিণত হয়কেবল অন্ধ যুবকের আনন্দ ফুরোয় নাকিন্তু তবু তার হৈচৈ আর আনন্দের ভেতরেও এখনকার নিস্তব্দতা তাকে তাড়া করে ফেরেঅনিশ্চয়তার অনুভব তাকে অস্বস্তিতে ফেলেশুরুতে তার মনে হয়েছিলো, এমন ক্ষণে ক্ষণে বদলানো মেয়েদের স্বভাবকখনো সে ভোরের শিশিরের মতো তরতাজা, অন্যসময় জলাবদ্ধ ঘোলাটে জলকখনো গোলাপের পাপড়ির মতো মসৃণ, আবার কখনো ক্যাকটাসের কাঁটাময় শরীরযদিও সবসময়ই আংটিটাকে আঙুলেই খুঁজে পায় সে, কিন্তু আঙুলটাকে এক এক সময় এক এক রকম লাগেযুবক মোটামুটি নিশ্চিত যে সবাই সবকিছু জানেতাহলে এ নীরবতার অর্থ কি? খাবার খেতে বসে নিছক এ ভাবনাতেই তার গলায় রুটি আটকে যায়এবং সেই মুহূর্ত থেকে আর একটাও কথা শোনা যায় না সেখানেএরপর থেকে সবকিছু ভেঙে পড়ার আশংকা নিয়ে তার দিন কাটতে থাকেএবারের শব্দহীনতার অর্থ ভিন্ন, সচেতন এ নীরবতার কারন দারিদ্র নয়, অপেক্ষা নয়, হতাশা নয়, এ নীরবতা আরো গভীর কিছু ধারণ করে আছেকোনরকম আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছাড়াই কেবল শব্দহীনতার জালেই তারা সবাই বাঁধাযুবতী বিধবা, তার তিন মেয়ে, এক কামরার একটা ঘর আর এক নতুন ধরনের নিস্তব্দতাঅন্ধ তেলাওয়াতকারীর সাথে সাথে নিস্তব্দতাও এখন এই ঘরের বাসিন্দাএ নিস্তব্দতায় যুবক আশ্রয় খোঁজেভাবে, তার বৈধ স্ত্রীই তার শয্যাসঙ্গী, যদিও এক এক দিন এক এক রকম শরীর, কিন্তু তার দেয়া আংটি থাকে তার আঙুলেযুবতী কিংবা বৃদ্ধ, মসৃণ অথবা এবড়োথেবড়ো, কখনো মোটা, কখনো ছিমছিমে, এ নিয়ে তার ভাবার কোন দায় নেইযাদের চোখ আছে, ভাবতে হলে তারা ভাবুক

যাদের দৃষ্টি আছে তারাই তো কেবল নিশ্চিত হতে পারে, ন্যায় অন্যায় বিচারের ভারও তাদেরই উপরদৃষ্টিহীনতা নিয়ে সে কেবল সন্দেহই করতে পারে যে সন্দেহ কেবল দৃষ্টিবানদের পক্ষেই মিটানো সম্ভবযতক্ষন সে দৃষ্টিহীন, ততক্ষন নিশ্চিত হবার কোন দায় তার নেইঅন্ধের আবার লজ্জা কিসের? নাকি তাদেরও লজ্জা পাবার কথা!

নিঃসঙ্গতার একশ বছর (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের উপন্যাস)

নিঃসঙ্গতার একশ বছর
মূল: গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ( অনুবাদ: আনিসুজ্জামান)
 
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর মতো আর কোনো উপন্যাস প্রকাশের পরপরই এতটা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে কিনা সন্দেহজনপ্রিয়তার বিচারে যেমন, তেমনি শিল্পকুশলতা আর শিল্পমুক্তির ক্ষেত্রেও এটি হয়ে উঠেছে এক অনন্য দৃষ্টান্তকেবল স্প্যানিশ সাহিত্যেই নয়, গোটা বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসেই একটি মাত্র উপন্যাসে ইতিহাস, আখ্যান, সংস্কার, কুসংস্কার, জনশ্রুতি, বাস্তব, অবাস্তব, কল্পনা, ফ্যান্টাসি, যৌন-অযাচার ও স্বপ্নসবকিছুর এমন স্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য সহাবস্থান আগে কখনও দেখা যায়নি
বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত কিংবদন্তিতুল্য এই উপন্যাসটি মূলভাষা থেকে অনূদিত হয়নি
এক ::
বহু বছর পর, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে যাবে সেই দূর বিকেলের কথা, যেদিন তার বাবা তাকে বরফ চেনাতে নিয়ে গিয়েছিলতখন মাকোন্দ প্রাগৈতিহাসিক ডিমের মতো প্রকাণ্ড, মসৃণ আর সাদা পাথরের পাশ দিয়ে বয়ে-চলা কাকচক্ষু নদীর পাশে মাটি আর নল দিয়ে তৈরি বিশটি বাড়ির এক গ্রামতখন পৃথিবী ছিল এতই নতুন যে বহু কিছুই ছিল নামের অপেক্ষায়, আর ওগুলোর উল্লেখ করতে হলে আঙুলের ইশারায় বুঝিয়ে দিতে হতপ্রতি বছর মার্চে ছন্নছাড়া এক জিপসি পরিবার গ্রামের পাশে তাঁবু খাটাত আর বাঁশি খোল-করতালের হল্লা তুলে দেখিয়ে বেড়াত নিত্যনতুন সব আবিষ্কারপ্রথমবার তারা আনে চুম্বক, বাবুইপাখির পায়ের মতো সরু লিকলিকে হাতওয়ালা দশাসই চেহারার আর বেয়াড়া রকমের দাড়ি-গোফওয়ালা জিপসি মেলকিয়াদেস দেখিয়েছিল এক জবরদস্তু প্রদর্শনী, যা ওর মতে মেসিদোনিয়ার আলকেমিদের আবিষ্কৃত অষ্টমাশ্চার্যদুই ধাতবপিণ্ড টানতে টানতে বাড়ি বাড়ি যায় সে আর গামলা, পাইলা, কড়াই, চুলা আর আংটাগুলো সব যার যার জায়গা থেকে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এসে সবাইকে তাজ্জব করে দেয়এমনকি বহু দিন আগে থেকে খুঁজে না-পাওয়া জিনিসগুলো বেরিয়ে আসে একই জায়গা থেকে, যেখানে সবচেয়ে বেশি খোঁজা হয়েছিল, আর স্ক্রু-পেরেকগুলো বেরিয়ে না আসতে পারার যন্ত্রণায় ক্যাচকেচিয়ে ওঠেজাদুকরি লোহার পিছনে সব টানতে টানতে জিপসিদের অপরিশীলিত উচ্চারণে মেলকিয়াদেস ঘোষণা করে, “সব জিনিসেরই নিজস্ব প্রাণ আছে; এ হচ্ছে কেবল ওদের আত্মাকে জাগিয়ে তোলার ব্যাপার

হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার ব্যাপারে কল্পনার কাছে হার মানত প্রকৃতির উদ্ভাবনী, এমনকি অলৌকিক ব্যাপার স্যাপার বা জাদুর ভেলকিওর কাছে মনে হল অকেজো এই আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর পেট থেকে সোনা তোলা যাবেসৎ মানুষ মেলকিয়াদেস ওকে সতর্ক করে, “এ কাজে ওটা লাগবে না

কিন্তু হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তখন জিপসিদের সততায় বিশ্বাসী ছিল না, ফলে নিজের খচ্চর ও এক জোড়া ছাগলের বদলে কিনে নেয় চুম্বকপিণ্ড দুটোওর বৌ উরসুলা ইগুয়ারান, যার ভরসা ছিল জন্তগুলো দিয়ে পালটাকে বাড়িয়ে তোলা, সে তাকে নিবৃত করতে পারে না

শিগ্রী এত সোনা হবে যে সারা বাড়ি মুড়ে ফেলার পরও আরও বেঁচে থাকবে,” স্বামী উত্তর দিল
ওর ধারণার সত্যতা প্রমাণের জন্য পরের কমাস সে প্রচুর খাটেউচ্চস্বরে মেলকিয়াদেসের মন্ত্র জপতে জপতে এলাকার প্রতি ইঞ্চি
সে চষে ফেলে, এমনকি নদীটার তলা পর্যন্তএতে একমাত্র সে তুলতে পারল লাউয়ের খোলের মতো ফাঁপা, পাথরে ভর্তি পঞ্চদশ শতকের এক বর্ম, যার প্রতি অংশ মরিচা-ধরা টুকরো দিয়ে জোড়া দেওয়াযখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ও তার অভিযানের চার সঙ্গী বর্মটাকে খুলে ফেলতে পারল, আবিষ্কার করল তামার লকেট গলায় চুন হয়ে যাওয়া এক নরকংকাল আর লকেটের ভেতরে নারীর একগোছা চুল

মার্চে ফিরে এল জিপসিরাএবার তারা নিয়ে এল আমস্টার্ডামের ইহুদিদের সর্বশেষ আবিষ্কার একটা দুরবিন আর বড় গোলাকৃতির এক আতশকাচগাঁয়ের একমাথায় এক জিপসি মেয়েকে বসিয়ে অন্য মাথায় তাঁবুতে লাগাল ওরা দুরবিনটাকেপাঁচ রেয়ালের বদলে লোকজন চোখ লাগাতে পারত দুরবিনটায় আর মেয়েটাকে দেখতে পাওয়া যেত এক হাত দূরত্বেবিজ্ঞান দূরত্বকে নিকেষ করেছেমেলকিয়াদেস ঘোষণা দিলশীঘ্রই লোকে ঘর থেকে না বেরিয়েই দেখতে পাবে পৃথিবীর সর্বত্র কী হচ্ছে

এক রৌদ্রতপ্ত দুপুরে প্রদর্শিত হল বিশাল সেই কাচ দিয়ে এক আশ্চর্য ঘটনা: রাস্তার মাঝে এক গাদা খড় রেখে সূর্যরশ্মি কেন্দ্রীভূত করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয় তারাহোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, তখন চুম্বকের ব্যর্থতার সান্তনা পায়নি, তবু এই নতুন আবিষ্কারটাকে হাতিয়ার হিসেবে লাগানোর এক বুদ্ধি আসে তার মাথায়আবার তাকে বিরত করার চেষ্টা করে মেলাকিয়াদেসকিন্তু আতশকাচের বদলে সেই চুম্বকপিণ্ড দুটো আর তিনটে ঔপনিবেশিক যুগের স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করতেই হয় তাকে

হতাশায় কেঁদে ফেলে উরসুলাস্বর্ণমুদ্রাগুলো ছিল ওর বাবার বঞ্চিত জীবনের সিন্দুকে জমানো ভান্ডারের একাংশ, যা উরসুলা বিছানার নিচে মাটিতে পুতে রেখেছিল কোনো এক জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্যহোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, এমনকি স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেবারও প্রয়োজনবোধ করে না, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করে কৌশলগত পরীক্ষানিরীক্ষায়সূর্যরশ্মি কেন্দ্রীভূত হয়ে শত্রুসেনার উপর কী রকম কাজ করে তা দেখার জন্য নিজের গা পুড়িয়ে ফেলে আর সেই ঘা সারতে তার অনেক সময় লেগে যায়এই বিপজ্জনক আবিষ্কারের ভয়ে ভীত স্ত্রীর সমস্ত প্রতিবাদ ও সতর্কতা সত্ত্বেও সে প্রায় বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছিলতার নতুন এই হাতিয়ারের কৌশলগত সম্ভাবনা নিয়ে হিসেব-নিকেশ করে কাটিয়ে দেয় দীর্ঘসময় নিজের কক্ষে যতক্ষণ পর্যন্ত না তৈরি করতে সফল হল শিক্ষণীয় এক আশ্চর্য স্বচ্ছ নির্দেশিকা আর অর্জন করল এক দুর্দমনীয় আত্মবিশ্বাসতার পরীক্ষানিরীক্ষার প্রমাণ আর বিভিন্ন বর্ণনামূলক অংকন সে পাঠিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষের হাতে

পাহাড় ডিঙিয়ে জলাভূমিতে পথ ভুলে, পায়ে হেটে খরস্রোতা নদী পেরিয়ে প্লেগ, হতাশা আর বন্য জন্তুর উৎপাতে প্রায় খরচের খাতায় চলে যেতে যেতে বেঁচে যায় ডাক-বওয়া খচ্চরগুলোর পথের দিশা পেয়ে, রাজধানী পর্যন্ত যাওয়া সে সময় প্রায় অসম্ভব ছিলতথাপি হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া দিব্বি করে বসে যে সরকারি হুকুম পেলেই সে রওনা হয়ে যাবেহাতে কলমে সামরিক কর্তৃপক্ষকে সৌরযুদ্ধের জটিল বিদ্যায় প্রশিক্ষিত করে তুলবেতারপর অনেক বছর সে জবাবের আশায় ছিলশেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করে ক্লান্ত হয়ে মেলকিয়াদেসকে নিজের উদ্যোগের ব্যর্থতার কথা দুঃখ করে জানালএই সময় জিপসি ওকে সততার প্রমাণ হিসেবে আতসকাচের বদলে সে ফিরিয়ে দিল পিণ্ড দুটো আর কিছু পর্তুগিজ মানচিত্রসহ নৌ-চালনার যন্ত্রপাতিসঙ্গে ছিল নিজহাতে লেখা সাধু হেরমানের পরীক্ষার সংক্ষিপ্তাকার, যাতে করে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া অ্যাস্ট্রল্যাব দিকদর্শনযন্ত্র আর সেক্সট্যান্টাকে কাজে লাগাতে পারেবর্ষা মওসুমের লম্বা মাসগুলো সে কাটিয়ে দিল বাড়ির ভেতর দিকটায় ছোট্ট একটা ঘরে যাতে করে কেউ তার পরীক্ষা নিরীক্ষায় বিঘ্ন ঘটাতে না পারেসংসারের সমস্ত দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে কাটিয়ে দিল রাতের পর রাত আঙিনায় তারাদের গতি অনুসরণ করেসঠিক মধ্যদুপুর বের করার পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টায় আরেকটু হলে তার সর্দি লেগে যেতযখন সে যন্ত্রগুলো ব্যবহারে পটু হয়ে উঠল, তখন স্থান-কাল সম্বন্ধে তার এমন ধারণা হল যে ঘর থেকে না বেরিয়েই সে অচেনা সাগরে পথ চলার, মনুষ্যহীন অঞ্চলে ভ্রমণের আর অসাধারণ সব মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষমতা পেয়ে গেলএটা ছিল এমন সময় যখন সে বাড়িময় ঘুরে ঘুরে কাউকে গ্রাহ্য না করে নিজের সঙ্গেই কথা বলত আর এদিকে উরসুলা আর ছেলেরা খেটে যাচ্ছিল কলা, কচু, মিষ্টি আলু, কচুর ছড়া, মিষ্টিকুমড়া আর বেগুনক্ষেতেকোনোরকম পূর্বাভাস ছাড়াই হঠাৎ করে তার কাজের নেশা বাধাপ্রাপ্ত হল; আর তার বদলে এল এক ধরনের মুগ্ধতাঅনেকদিন কেটে গেল ঘোরে-আক্রান্ত মানুষের মতো নিম্নস্বরে আশ্চর্য সব ছড়া জপতে জপতে, যেগুলো ছিল তার নিজেরই বোধের অগম্য

দুই ::

অবশেষে ডিসেম্বরের এক মঙ্গলবার নাস্তার সময় আচমকা বের করে দিল ওর ভিতরের সমস্ত চিন্তার ঘূর্ণিপাকবাচ্চারা বাকি জীবন মনে রাখবে কী মহান গাম্ভীর্য নিয়ে ওদের বাবা টেবিলের মাথায় বসে, জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে ঘোষণা করে তার দীর্ঘ রাত জাগা আর কল্পনায় আবিষ্কারের কথা: পৃথিবীটা কমলালেবুর মতো গোল

উরসুলা ধৈর্য হারিয়ে ফেলেযদি তুমি পাগল হয়ে থাক, তাহলে একাই হওচিৎকার করল,” কিন্তু তোমার জিপসী চিন্তার সঙ্গে বাচ্চাদের জড়ানোর চেষ্টা করো নাক্রোধের বশে এ্যাস্ট্রোল্যাবটা মেঝেতে ছুঁড়ে ভেঙে ফেলার পরও নির্বিকার হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া স্ত্রীর ধৈর্যহীনতায় মোটেই ভড়কে যায় নাসে আরেকটি তৈরি করে নিজের ছোট্ট কামরায় গ্রামের লোকদের জড়ো করে আর তাদের চোখের সামনে তুলে ধরে অবোধ্য এই সম্ভাবনা যে পুব দিক বরাবর একটানা জাহাজ চালিয়ে গেলে তা আবার উৎসেই ফিরে আসবেগায়ের লোকজন যখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার পাগল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত, তখনই সবকিছু স্বাভাবিক করার জন্য ফিরে আসে মেলকিয়াদেসবিশুদ্ধ জ্যোতির্বিদ্যক অনুমান দ্বারা যে এমন এক তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছে যা বাস্তবে প্রমাণিত, যদিও মাকন্দোতে তা ছিল অজানাতিনি সবার সামনে তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেনআর তার মুগ্ধতার নজির হিসেবে উপহার দেয় তাকে এক আলকিমিয়ার পরীক্ষাগার যা ভবিষ্যতে এ গ্রামের উপর বিশাল প্রভাব ফেলেছিল


সেই সময় আশ্চর্য দ্রুততায় বুড়ো হয়ে গিয়েছিল মেলকিয়াদেসওর প্রথম দিককার সফরের সময় মনে হতো সে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ারই বয়সীদুই কান ধরে একটা ঘোড়াকে ধরাশায়ী করার মতো প্রবল শক্তিকে হোসে আর্কাদিও নিজের শরীরে ধরে রাখলেও জিপসীটাকে দেখে মনে হতো নাছোড় রোগে সে কাবু হয়ে গেছেএ ছিল আসলে পৃথিবীর চারদিকে তার অগণিত ভ্রমণের সময় বিরল সব রোগ বাধানোর ফলপরীক্ষাগারটা গড়ে তুলতে সাহায্য করার সময় নিজেই হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিরয়াকে সে বলছিল যে মৃত্যু ওকে তাড়া করছিল সর্বত্র, শেষ থাবা বসাবার সিদ্ধান্ত না নিলেও সে তার গন্ধ শুঁকে বেড়িয়েছে ঠিকইমানবজাতিকে তাড়িয়ে বেড়ানো যতসব মহামারী আর বিপদ আপদের হাত থেকে ফেরারীর মতো ছিলো সেপারস্যে পেলাগ্রা রোগ থেকে, মালয় দ্বীপপুঞ্জের স্কার্ভি, আলেকজান্দ্রিয়ার কুষ্ঠ, জাপানের বেরিবেরি, মাদাগাস্কারের বুবনিক প্লেগ, সিসিলির ভূমিকম্প আর ম্যাগিলান প্রণালীর জাহাজডুবী থেকে বেঁচে গিয়েছিলো সেনস্ত্রাদামুর মূল রহস্যগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বলে কথিত এই অদ্ভুত লোকটি বিষাদগ্রস্ত, বিষন্নতার বলয়ে ঢাকা, আর চেহারা-সুরত ছিল এশীয় ধরনের, যাকে দেখলে মনে হতো যেন ঘটনার অজানা দিকগুলোও তার জানাকাকের ডানার মতো বিস্তৃত কালো রংয়ের এক বিশাল টুপি পড়তো সে, আর গায়ে চড়ানো থাকতো শতাব্দীর সবুজ, উজ্জল এক মখমলের কুর্তাবিপুল জ্ঞান আর রহস্যময় ব্যাপ্তি সত্ত্বেও তার মধ্যে এক মানবিক দায়ভার ছিলো, এক পার্থিব দশার কারণে দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো সমস্যাগুলো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে রাখতোঅনুযোগ করত বয়সজনিত ব্যথা নিয়ে, ভুগত একেবারেই গুরুত্বহীন আর্থিক নানান ঝামেলায়, স্কার্ভির কারণে দাঁতগুলো পড়ে যাওয়ায় হাসা বন্ধ করে দিয়েছিল সে অনেক আগেইসেই রুদ্ধশ্বাস দুপুরে যখন সমস্ত গোপন কথা ফাঁস করছিল সে, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তখন নিশ্চিত হলো যে, সেই সময়টাই ছিলো মহান বন্ধুত্বের সূচনাশিশুরা চমৎকৃত হতো তার উদ্ভট গল্প শুনেআউরেলিয়ানোর বয়স তখন পাঁচের বেশী হবে নাসেই আউরেলিয়ানো পরবর্তী জীবনে সেই বিকেলে লোকটাকে যেভাবে দেখেছে তার সবকিছু মনে রাখবেজানালা থেকে আসা ধাতব শব্দ আর মৃদু আলোর বিপরীতে বসে তার গলা থেকে উঠে আসা প্রগাঢ় শব্দ দিয়ে উজ্জল করছে কল্পনার সবচেয়ে কালো অঞ্চলগুলোকে; ততক্ষণে তার কপালের দুই রগ বেয়ে পড়ছে গরমে গলে-পড়া চর্বিওর বড় ভাই হোসে আর্কাদিও, সেই বিস্ময়কর প্রতিমাকে এক বংশানুক্রমিক স্মৃতি হিসেবে তুলে দিয়ে যাবে তার সমস্ত উত্তরপুরুষের হাতেঅন্যদিকে, উরসুলা সেবারের সফরের মন্দ স্মৃতিটাই মনে রেখেছে; কারণ, সে ঘরে ঢোকার সময় মেলকিয়াদেস বেখেয়ালে পারদের একটা গ্লাস ভেঙে ফেলে
——————————-
আর্হেন্তিনার বুয়েনোস আইরেস-এর
এদিতোরিয়াল সুদামেরিকানা প্রকাশনী থেকে
প্রকাশিত নিঃসঙ্গতার একশ বছরউপন্যাসের
প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ

——————————-
এতো শয়তানের গন্ধ, বলল উরসুলা
একদমই নয়, শুধরে দিয়ে মেলকিয়াদেস বলে, সবাই জানে শয়তানের মধ্যে রয়েছে গন্ধকের গুণ আর এটাতো সামান্য এক ক্ষয়কারী পদার্থ ছাড়া বেশি কিছু নয়

সার্বক্ষনণক নীতিবাগীশ মেলকিয়াদেস সিঁদুর বর্ণের পদার্থের নারকীয় গুণ সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে বসে, কিন্তু উরসুলা তাতে কান দিল না, বরঞ্চ বাচ্চাদের নিয়ে গেল প্রার্থনায়ঐ কামড় বসানো গন্ধ মেলকিয়াদেসের স্মৃতির সঙ্গে এক হয়ে সবসময় তার মনে বসে থাকবে

অসম্পূর্ণ পরীক্ষাগারে বাসন কোসন, ফানেল. বকযন্ত্র, ফিল্টার ও ছাঁকনির কথা বাদ দিলেও তাতে ছিলো সরু গলাওয়ালা এক লম্বা কাচের টেস্টটিউব, এক নকল পরশ পাথর, আর মারিয়া দে হুদিয়ার সর্বাধুনিক সূত্রানুযায়ী জিপসীদের নিজ হাতে বানানো এক তে-হাতা পাতন যন্ত্রএছাড়াও মেলকিয়াদেস রেখে গেল সাত গ্রহের সঙ্গে সম্পর্কিত সাতটি ধাতুর নমুনা, আর সোনা দ্বিগুণ করার জন্য মুসা ও জোসিমার সূত্রাবলীআর পরশ পাথর বানাতে আগ্রহী কেউ যাতে এ-সবের অর্থোদ্ধার করতে পারে সেজন্য মহতী শিক্ষার পদ্ধতি বিষয়ে একগুচ্ছ টীকাটিপ্পনী ও নকশা

সোনার পরিমান দ্বিগুণ করার প্রক্রিয়ার সহজতায় প্রলুব্ধ হয়ে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া কয়েক সপ্তাহ যাবত ধরনা দেয় উরসুলার কাছে ঔপনিবেশিক আমলের স্বর্ণ মুদ্রাগুলো মাটি খুঁড়ে তোলার জন্য, যাতে করে সে সোনার পরিমাণ ইচ্ছেমতো বাড়াতে পারেসবসময়ের মতো এবারও উরসুলা হার মানল স্বামীর ক্রমাগত তাগাদার কাছেহোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তিরিশটি স্বর্ণমুদ্রা, তামার গুড়ো, হরিতাল, গন্ধক আর সীশে এক কড়াইতে রেখে গলিয়ে ফেলেওগুলোকে এরপর এক পাত্র রেড়ির তেলে গনগনে আগুনে জ্বাল দিতে থাকে, যতক্ষণ না সেটা এক ঘন তরল পদার্থে পরিণত হয়, যা দেখতে সোনার উজ্জ্বলতার চেয়ে বরং কদর্য মিষ্টি গাদের মতএই ঝুঁকিবহুল আর অসহিষ্ণু পাতনের পদ্ধতির কারণে নির্বিকার পারদ, গ্রহযুক্ত সপ্ত ধাতু, সাইপ্রাসের কাঁচ মূলোর তেলের অভাবে আর একবার শুয়োরের তেলে রন্ধনের ফলে উরসুলার মূল্যবান উত্তরাধিকার পরিণত হয় কয়লা হয়ে-যাওয়া শুয়োরের চামড়ার মত এক পদার্থে, যা নাকি পাত্রের তলা থেকে আর আলাদা করা যায় না

যখন জিপসীরা ফিরে আসে, তখন উরসুলা গ্রামের সমস্ত লোকজনকে ওদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে রাখে কিন্তু ভয়ের চেয়ে কৌতূহলই জয়ী হলোকারণ সেবার যখন জিপসীরা সব রকম বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কানের পর্দা-ফাটানো আওয়াজ তুলে সারা গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন ঘোষক এসে জিপসীদের আবিষ্কৃত সবচেয়ে চমৎকার বস্তু প্রদর্শনের ঘোষণা দিয়েছিলো
(চলবে)

তিন ::

যাতে করে পৃথিবীর সবাই চলে যায় তাঁবুতে, আর এক সেন্টের বিনিময়ে দেখতে পায় বলিরেখাহীন, নতুন ঝকমকে দাঁতসহ এক যুবক মেলকিয়াদেসকেস্কার্ভিতে ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত, তোবরানো গাল আর চুপসে যাওয়া ঠোঁটের কথা যাদের মনে ছিল ভয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় তারা জিপসীর অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা দেখেএই ভয় আতংকে পরিণত হয় যখন মেলকিয়াদেস তার মাড়ি সংলগ্ন অক্ষয় দাঁতগুলোকে বের করে দর্শকদের দেখায় মুহুর্তের জন্যআর তাৎক্ষনিকভাবে সে রূপান্তারিত হয় আগের বছরগুলোতে দেখা একই লোকেওগুলোকে সে আবার লাগিয়ে যৌবনকে ফিরিয়ে এনে নতুন করে কর্তৃত্বময় হাসি আসেস্বয়ং হোসে আর্কাদিও বুয়েনদিয়া মনে করে মেলকিয়াদেসের জ্ঞান অসহ্য রকমের চরম অবস্থায় পৌঁছে গেছে, কিন্তু যখন জিপসী লোকটা তার সঙ্গে একাকী নকল দাঁতের কারিগরি খুলে বলে তখন অনুভব করে এক পরিপূর্ণ প্রসন্নতাএটা তার কাছে একই সঙ্গে এতই সহজ আবার জ্ঞানময় মনে হয় যে আলকেমি নিয়ে গবেষণা করার সমস্ত আকর্ষণ তার রাতারাতি উবে যায়; নতুন করে সে ভোগে বদমেজাজে, আর সময় মত না খেয়ে সাড়া বাড়িময় ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটায়পৃথিবীতে অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটে চলছেবলে উরসুলাকে, “ঐখানে, নদীর অপর পাড়ে আছে সব রকমের যাদুকরী যন্ত্রপাতি আর আমরা কিনা দিন কাটাচ্ছি গাধার মতযারা ওকে মাকোন্দোর পত্তনের সময় থেকে চিনত তারা আশ্চর্য হতো এটা দেখে যে মেলকিয়াদেসের প্রভাবে সে কতই না বদলে গেছে

প্রথম দিকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ছিল তরুণ গোত্রপতি ধাঁচের, যে চাষাবাসের শিক্ষা দিত, বাচ্চাকাচ্চা আর জীবজন্তু লালন পালনের উপদেশ দিত, সর্বক্ষেত্রেই সাহায্য করতএমনকি শারিরীক ভাবেও গোত্রের অগ্রগতির জন্যযেহেতু প্রথম থেকেই তার বাড়িটা ছিল গাঁয়ের সেরা, তাই অন্য বাড়িগুলোও তৈরি হয়েছিল তারই আদলে এবং একই রকমেবসার ঘরটা ছিল বেশ বড় এবং আলোময়, উঠোনের মত খাবার ঘর আনন্দময় রংয়ের ফুল দিয়ে সাজানো, দুটো শোবার ঘর, বিশাল চেষ্টনাট গাছসহ এক উঠোন, সাজানো ফলমূলের বাগান আর শান্তিতে এক সঙ্গে বসবাসরত ছাগল, শুয়োর আর মুরগীর খোয়াড়শুধু তার বাড়িতেই নয়, সমস্ত গ্রামেই, যেটা এক মাত্র নিষিদ্ধ প্রাণী ছিল, সেটা হলো লড়াইয়ের মোরগ

স্বামীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করার ক্ষমতা ছিল উরসুলারকর্মঠ, ছোটখাটো, কঠোর, যে মেয়েটা ছিল অবিনাশী স্নায়ুশক্তির অধিকারী, জীবনে কেউ তাকে গান গাইতে শোনেনি, তার উপস্থিতি ছিল সব সময় ডাচ্ লিনেনের স্কার্টের মৃদ্যু খসখসানীসহ সকাল থেকে রাত পর্যন্তপেটানো মাটির মেঝে, চুনকালিবিহীন কাদার দেয়াল, নিজেদের তৈরি করা সাদামাটা আসবাবপত্র ছিল সব সময় পরিস্কারআর যে পুরোনো সিন্ধুকে কাপড়চোপড় রাখা ছিলো, সেখান থেকে বের হতো তুলসী পাতার মৃদু গন্ধ
হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ছিল গায়ের সবচেয়ে উদ্যমী লোক, ওরকম উদ্যামী লোক গ্রামে আর কখনই দেখা যাবে নাবাড়িগুলোকে সে এমনভাবে বসিয়েছিল যে সব বাড়ি থেকেই নদীতে আসতে পারত সবাই এবং পানি নিতে পারত একই পরিশ্রমেরাস্তাগুলোকে সে এমনভাবে সারি করেছিল যাতে গরমের সময় কোন বাড়িই একটার চেয়ে অপরটা বেশী রোদ না পায়অল্প কয়েক বছরের মধ্যে, তিন শঅধিবাসীর মাকন্দো ছিল যে কোন চেনাজানা গ্রামের চেয়ে অনেক বেশি সাজানো এবং শ্রমসাধ্যসত্যিকার অর্থে ছিল এক সুখী গ্রামযেখানে কারোর বয়স তিরিশের বেশী ছিল না এবং কেউ মারা যায়নি

বসতি স্থাপনের সময় থেকেই হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বানাতো ফাঁদ আর খাঁচাঅচিরেই সে টুর্পিয়াল, ক্যানারি, আসুলেহোস আর পেতিররোহোস পাখি দিয়ে শুধু নিজের বাড়িই নয়, পুরো গ্রামটাই ভরে ফেললোএতসব পাখির সমবেত গান এতই হতবুদ্ধিরকর হয়ে ওঠে যে উরসুলা মোম দিয়ে কান বন্ধ করে রাখতো যাতে সে বাস্তববোধ হারিয়ে না ফেলেমেলকিয়াদেসের গোষ্ঠিটা যখন প্রথমবার এসে মাথাব্যাথা সারানোর কাঁচের গুলি বিক্রি করলো তখন সবাই অবাক হয়েছিল যে কি করে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন জলাভূমিতে হারিয়ে যাওয়া এই গ্রামটাকে ওরা খুঁজে পেয়েছে আর জিপসীরা জানালো যে পাখীর কলতান শুনেই তারা দিক খুঁজে পেয়েছে

তার সেই সামাজিক উদ্দীপনা অল্প সময়ের মধ্যেই উবে যায় চুম্বকের মোহ, জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ, পদার্থ রূপান্তরের স্বপ্ন, আর বিশ্বের অত্যাশ্চর্যকে জানার তাড়নায়উদ্যমী আর পরিচ্ছন্ন এক লোক থেকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া পরিণত হয় এক অলস, পোশাকে অমোনযোগী, আর এমনই বুনো দাড়িওয়ালা এক লোকে যে দাড়িগুলো উরসুলা রান্না ঘরের ছুরি দিয়ে অতি কষ্টে একটা আকার দিয়ে দেয়এমন কেউ ছিল না যে তাকে আজব কোন যাদুমন্ত্রের শিকার বলে মনে করতো নাতার পাগলামির ব্যাপারে সুনিশ্চিত লোকজন পর্যন্ত কাজ আর সংসার ছেড়ে দিয়ে তাকে অনুসরন করেসে কাঁধে তুলে নিল তার বিশ্লেষণ করার যন্ত্রপাতিগুলো এবং যোগ দিতে বলল সবাইকে এক রাস্তা খোলার জন্য যা নাকি মাকন্দোকে সংযুক্ত করে দেবে বড় সব আবিস্কারের সঙ্গে
ঐ এলাকার ভৌগলিক অবস্থান সম্বন্ধে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ছিল পুরোপুরি অজ্ঞজানতো যে পূব দিকে ছিল এক দুর্গম পর্বতমালা, আর পর্বতমালার অপর দিকে প্রাচীন শহর রিয়োহাচা, যেখানে, ওর দাদা প্রথম আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার ভাষ্যমতে, প্রাচীনকালে স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক বিশাল কুমীর শিকার করেছিল কামান দেগে বিনোদনের জন্য আর পরে ক্ষতস্থান জোড়া দিয়ে ওতে খড় ভরা হতো রাণী ইসাবেলের কাছে নেয়ার জন্যযৌবনে, সে এবং সমস্ত পুরুষ, মহিলা, বাচ্চাকাচ্চা, পশু আর ঘরোয়া জিনিসপত্রসহ পর্বত পাড়ি দিয়েছিল সাগরে যাওয়ার পথ খুঁজতে এবং ছাব্বিশ মাস পর সে চেষ্টায় ক্ষান্তি দিয়ে মাকন্দোয় পত্তনি গড়ে তোলে যাতে করে আবার ফেরার রাস্তা পাড়ি দিতে না হয়ওটা ছিল এমন এক রাস্তা যাতে তার কোন আগ্রহ ছিল না, কারণ ওটা নিয়ে যেতে পারতো কেবল অতীতের দিকেদক্ষিণে ছিল সীমাহীন জলজ উদ্ভিদে ঢাকা জলাভূমি আর জিপসীদের কথানুযায়ী এই বিশাল জলাভূমির বিপুল বিশ্বের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল নাভুল করে মনে হতো বিশাল পশ্চিমের জলভূমিটা দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত, যেখানে ছিল নারীর শরীর, মাথা, আর কোমল চামড়াসহ তিমিজাতীয় প্রাণী যাদের বিশাল স্তনের মোহে পড়ে নাবিকরা দিক হারাতোজিপসীরা ছয় মাস এই পথ ধরে নৌচালনা করে এক ফালি শক্ত জমিতে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত, যেখান দিয়ে ডাক-বওয়া খচ্চরগুলো চলাচল করেহোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার হিসাব মতে সভ্যজগতের সংস্পর্শে আসার একমাত্র সম্ভাব্য রাস্তা ছিল উত্তরেসুতরাং সে জঙ্গল কাটার ও শিকারের যন্ত্রপাতি তুলে দেয় তাদের হাতে যারা মাকন্দোর স্থাপনার সময় থেকে তার সঙ্গীএকটা থলির মধ্যে নির্দেশনার যন্ত্র আর মানচিত্রগুলো ভরে আরম্ভ হলো সেই দুঃসাহসী অভিযাত্রা

প্রথম কয়েকদিন উল্লেখযোগ্য কোন বাঁধাই তারা পেল নানদীর পাথুরে তীর ধরে নীচে নামতে নামতে চলে আসে তারা সেই জায়গায় যেখানে অনেক বছর আগে পাওয়া গিয়েছিল এক সৈনিকের বর্ম আর সেখানেই প্রবেশ করে বুনো কমলাবনের ভেতর এক পথ ধরেপ্রথম সপ্তাহ শেষ হওয়ার পর এক হরিণ শিকার করে আগুনে ঝলসায় তারা কিন্তু সন্তুষ্ট হয় শুধুমাত্র অর্ধেকটা খেয়ে বাকি অর্ধেক নুন মাখিয়ে ভবিষ্যতের দিনগুলোর জন্য রেখে দেয়একই সতকর্তার কারণে বড় টিয়া পাখি খাওয়ার ধারণাটাও তারা বাদ দেয় যার নীল মাংশ ছিল আঁশটে আর সুগন্ধিময়দশদিন ধরে তারা সূর্যের মুখ দেখতে পেল নাআগ্নেয়গিরির ছাইয়ের মতো মাটি হয়ে এলো নরম আর স্যাঁতসেতেবনজঙ্গল ক্রমাগত আরও বেশি প্রতারণাময় হয়ে উঠেছিলো, আর পাখির কলরব আর বানরের কোলাহলকে আরও দূরের মনে হচ্ছিলোআর পৃথিবী চিরকালের জন্য হয়ে উঠল আরও বিষাদগ্রস্থ
অভিযাত্রীরা ওদের আদি পাপেরও আগের, আদিতম স্মৃতির তাড়নায় সেই স্যাঁতসেতে স্বর্গে আর নির্জনতায় ডুবে যায় যেখানে জুতা দেবে যায় ধোয়াটে তেলের গর্তে আর দাগুলো ধ্বংস করে রক্তিম লিলিফুল আর সোনালি সালামান্দার
এক সপ্তাহ ধরে প্রায় কথাবার্তা ছাড়া নিশাচরের মত, দমবন্ধ করা রক্তের গন্ধে ফুসফুস ভর্তি করে অগ্রসর হলো এক শোকাবহ বিশ্বের মধ্য দিয়ে যা কেবল আলোকিত হয়ে আছে আলোকদায়ী পোকামাকড় দ্বারাওরা আর ফিরতে পারত না কারন যে পথ তৈরি হয়েছিল অল্পক্ষণের মধ্যেই তা বন্ধ হয়ে আসছিল নতুন গাছপালায়, যেন এই মাত্র সেগুলো বেড়ে উঠছিল ওদের চোখের সামনেকিছু আসে যায় না,” বলতো হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, “আসল কথা হচ্ছে দিক না হারানোসেই ভুতগ্রস্ত এলাকা থেকে বেরিয়ে আসার আগ পর্যন্ত সারাক্ষণ কম্পাসের দিকে লক্ষ রেখে পথ দেখিয়ে যাচ্ছিলো ওর লোকদের অদৃশ্য উত্তরের দিকেসেটা ছিল নক্ষত্রবিহীন এক ঘন রাত কিন্তু অন্ধকার ভরা ছিল নতুন আর নির্মল বাতাসেদীর্ঘ পথযাত্রায় অবসন্ন হয়ে ওরা হ্যামকে গভীর ঘুমে কাটিয়েছিলো দুই সপ্তাহ প্রথমবারের মতযখন জেগে উঠল বিম্ময়ে আপ্লুত হয়ে গেল তারা, সূর্য তখনও মাথার উপরেওদের সামনে, তাল গাছ আর ফার্নসকালের শুভ্র সুক্ষ্ণকণার আলোয় বেষ্টিত নিঃস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল জাহাজডান দিকে সামান্য কাত হয়ে থাকা জাহাজের অক্ষত মাস্তল থেকে ঝুলছিল দুভাগ হয়ে যাওয়া, দুর্বল, আকিও ফুলাংকিত পালের অংশপাথুরে মাটিতে শক্তভাবে গেথে থাকা খোলটি ঢাকা রয়েছে শিলীভূত উজ্জ্বল শামুক আর নরম শৈবালেনিঃসঙ্গতা আর বিস্মৃতির জায়গা নিয়ে সমস্ত কাঠামোটা যেন দখল করে আছে এক নিজস্ব ব্যাপ্তি যা সময়ের কলুষ আর পাখপাখালির আচার আচরণে দুর্ভেদ্যজাহাজের ভেতরে অভিযাত্রীরা গোপন উদ্দীপনায় যা খুঁজে পেল তা ফুলের এক নিবিড় বন ছাড়া বেশি কিছু না

ধারে কাছেই সমুদ্র থাকার ইঙ্গিত বহনকারী এই জাহাজ আবিস্কার হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার সমস্ত উৎসাহ ভেঙে দেয়প্রচন্ড আত্মত্যাগ আর খেসারত দিয়ে খুঁজে না পেয়ে আর না-খুঁজেই রাস্তার মাঝখানে এক অমোঘ বাধা স্বরূপ সমুদ্রকে দেখতে পেয়ে নিজের দুষ্ট নিয়তিকে এক বিদ্রুপের মত মনে হয় তার কাছেঅনেক বছর পর কর্ণেল আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া আবার যখন এই জায়গাটা অতিক্রম করে তখন তা হয়ে গিয়েছিলো ডাক চলাচলের এক নিয়মিত রাস্তা আর জাহাজের একমাত্র যে জিনিসটা দেখতে পেয়েছিল তা হলো আফিম খেতের মাঝে এর পোড়া কাঠামোটাআর তখনই সে নিশ্চিত হয় যে ওটা তার বাবার খামখেয়ালী কল্পনায় সৃষ্ট কোন গল্প নয়, আর নিজেই নিজেকে সে প্রশ্ন করে কিভাবে জাহাজটা কঠিন মাটিতে এতখানি ঢুকে গিয়েছেকিন্তু আরও চারদিন ভ্রমণের পর জাহাজ থেকে সমুদ্রকে যখন বারো কিলোমিটার দূরত্বে পেল তখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া এ নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করল নাতার এত আত্মত্যাগ আর ঝুঁকিপূর্ণ এই অভিযানের, স্বপ্নের শেষ হলো এই ফেনিল, নোংরা, ছাইরঙা সমুদ্রের সামনে যা তার প্রাপ্য নয়


চার ::

সর্বনাশচিৎকার করল সেমাকন্দোর চারদিক পানিতে ঘিরে আছে

অভিযান থেকে ফিরে এসে মানচিত্রে যুক্তিহীনভাবে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার আঁকা মাকন্দো উপদ্বীপের ধারণাটি অনেকদিন পর্যন্ত টিকে ছিলরেখাগুলো এঁকেছিল প্রচন্ড রাগে, যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতাকে অতিরঞ্জিত করে, যেন চরম বুদ্ধিহীনভাবে জায়গাটা বেছে নেবার জন্য নিজেকে শাস্তি দেবার জন্যকখনই পৌঁছুতে পারব না কোথায়ও,” খেদ প্রকাশ করে সে উরসুলার কাছে, “ বিজ্ঞানের সুবিধাগুলো না পেয়ে এখানেই আমাদের জীবন পচতে থাকবেছোট্ট গবেষণাগারে কয়েক মাসের উপর্যুপরি চিন্তার ফলপ্রসূ এই নিশ্চয়তা মাকন্দোকে আরও উপযুক্ত এক অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণে তাকে উদ্বুদ্ধ করেকিন্তু এইবার, উরসুলা তার এই অস্থির পরিকল্পানার কথা আগেই আঁচ করে ফেলেএরই মধ্যে স্থানান্তরের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করা পুরুষদের হুজুগের বিরুদ্ধে গোপন ও পিপড়ার মতো ক্ষান্তিহীন এক পরিশ্রমে গ্রামের নারীদের সে উপযোগী করে তোলে
পুরো ব্যাপারটি একেবারে বিশুদ্ধ আর সাধারণ একটা মরিচীকায় রূপান্তরিত হ্ওয়ার আগ পর্যন্ত হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বুঝতেই পারলো না কখন, এমনকি কোন প্রতিকূল শক্তির গুণে তার পরিকল্পনাগুলো নানান সব অজুহাত, বিপত্তি ও ওজরের বিশৃঙ্খলার মধ্যে জড়িয়ে পড়লো

উরসুলা তাকে নিষ্পাপ মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলো, এমনকি ওর প্রতি একটু দয়াও বোধ হলোগবেষণাগারের জিনিষগুলোকে তাদের মূল বাক্সের ভেতর যখন গুছিয়ে রাখছিলো তখন ওকে কোনার ছোট্ট ঘড়টিতে স্থান পরিবর্তনের স্বপ্নের কথা বিড়বিড় করে বলতে শুনা গেল উরসুলা ওকে কাজগুলো শেষ করতে দিলবাক্সগুলোতে পেরেক ঠোকা, আর ঝর্না কলম দিয়ে বাক্সের গায়ে নামের আদ্যাক্ষর লিখাও শেষ করতে দিল কোনরকম গঞ্জনা ছাড়াই, যদিও উরসুলা জানতো যে ও জেনে গেছে (কারণ সে শুনতে পেয়েছিলো ওর বধির স্বগতোক্তি) গ্রামের পুরুষরা তার এই উদ্যোগে সঙ্গী হবে নাকেবল ঘরের দরজাটা যখন তুলতে যাচ্ছে তখনই শুধু উরসুলা সাহস করল জিজ্ঞেস করে কেন সে খুলছে, আর তার জবাবটা সে দিলো তিক্ততার সঙ্গে যেহেতু কেউ যেতে চায় না, আমরা একাই যাব”, উরসুলা এতে বিচলিত হলো না

- আমরা যাব নাবলল সে- আমরা এখানেই থেকে যাব, কারণ এখানেই আমার এক ছেলেকে পেয়েছি

- এখনও পর্যন্ত কেউ মরেও নি - সে বললমাটির তলায় না যাওয়া পর্যন্ত কেউ-ই কোনো জায়গার নয়

উরসুলা এক কোমল দৃঢ়তায় জবাব দিল - এখানে থেকে যাওয়ার জন্য যদি আমাকে মরতে হয় তবে আমি মরব

হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বিশ্বাস করে উঠতে পারল না তার বৌয়ের ইচ্ছে শক্তি এতটা দৃঢ় হতে পারেচেষ্টা করল তার যাদুময়ী আজগুবি কল্পনা আর বিস্ময়কর এক পৃথিবীর অঙ্গীকার দিয়ে ওকে প্রলুব্ধ করতে যেখানে মাটিতে যাদুকরী তরল পদার্থ ছিটালেই গাছ হয় মানুষের ইচ্ছানুযায়ী, যেখানে বিক্রি হয় খুব সস্তায় ব্যাথা সারানোর সব যন্ত্রপাতিকিন্তু উরসুল ছিল নিরাসক্ত ওর দূরদৃষ্টিতে

- এই সব আজগুবী চিন্তার চেয়ে বরং তোমার সন্তানদের দায়িত্ব নেয়া উচিৎউত্তর দিল- দেখ ওদের কী অবস্থা, যেন আল্লার ওয়াস্তে ঘুরে বেড়ানো গাধাহোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া আক্ষরিক অর্থেই বৌয়ের কথাগুলো ধরে নিলজানলা দিয়ে তাকিয়ে রৌদ্রতপ্ত বাগানে দুই ছেলেকে খালি পায়ে দেখতে পেল, ঐ মূহুর্তে ওর মনে হলো কেবল উরসুলার যাদুবলে যেন ওদের অস্তিত্বের শুরু হয়েছেকিছু একটু ঘটে গেল তার ভিতরে, রহস্যময় এবং সুনির্দিষ্ট এমন একটা ব্যাপার যা তাকে সত্যিকারের সময় থেকে উপরে ফেলে নিয়ে যায় স্মৃতির এক অনাবিস্কৃত অঞ্চলেউরসুলা যখন এ জীবনে গ্রাম ছেড়ে না যাবার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিল তখন সে মগ্নতা নিয়ে বাচ্চাদের দেখতে থাকে চোখগুলো ছলছল হ্ওয়া পর্যন্তহাত দিয়ে দুচোখ মুছে হাল ছেড়ে দেয়ার এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে

- বেশ - বলল - ওদের বল যাতে আমাকে বাক্স থেকে জিনিষগুলো বের করতে সাহায্য করে

বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়, হোসে আর্কাদিওর চৌদ্দ বছর পূরণ হয়েছেওর ছিল চৌকোমাথা, মাথা ভর্তি চুল আর চরিত্র ছিল বাপের মতই স্বেচ্ছাচারীশারীরিক বৃদ্ধি আর শক্তিমত্তা একই রকম হলেও তখন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে ওর ছিল কল্পনাশক্তির কিছু অভাবও পেটে আসে এবং জন্ম গ্রহণ করে মাকন্দো পত্তনের আগে কষ্টকর পর্বতসংকুল পাড়ি দেবার সময়, বাবা-মা খোদাকে ধন্যবাদ জানায় ওর শরীরে কোন জন্তুর অঙ্গ ছিল না বলেআউরেলিয়ানো ছিল মাকন্দোতে জন্মানো প্রথম মানবসন্তান, মার্চে ছয় বৎসর পূরণ হবেস্বভাবে সে নীরব এবং মনোযোগীমায়ের পেটে থাকতে কান্নাকাটি করত আর জন্মেছিল চোখ খোলা অবস্থায়যখন ওর নাড়ি কাটা হচ্ছিল তখন ঘরের জিনিষপত্র চিনতে চিনতে সে মাথা নাড়ছিল এদিক ওদিকলোকজনের চেহারা পরীক্ষা করছিল এক বিস্ময়হীন কৌতুহল নিয়েপরে, যারা ওকে দেখতে এসেছিল তাদের দিকে গুরুত্ব না-দিয়ে সমস্ত মনযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিল তালের পাতায় ছাওয়া ছাদটার দিকে যেটা প্রচন্ড বৃষ্টির চাপে প্রায় ভেঙ্গে পরার উপক্রমওর দৃষ্টিপাতের এই তীব্রতার কখা আর মনে পড়েনিমনে পড়লো যেদিন সে জলন্ত উনুনে বলক দিতে থাকা স্যুপের পাতিল সরিয়ে টেবিলে রাখছিল সেই মুহূর্তে তিন বছরের ছোট্ট আউরেলিয়ানে ঘরে এসে হাজির দরজায় দাড়ানো কিংকর্তব্যবিমুঢ় শিশুটি বলল ‘‘ওটাতো পড়ে যাবে”-পাতিলটা টেবিলের মাঝখানে ভালভাবেই রাখা ছিল, কিন্তু শিশুর ঘোষণামাত্র , যেন অভ্যন্তরিন এক গতির দ্বারা চালিত হয়ে টেবিলের কিনারে চলে আসে সেটি আর মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়ভীত উরসুলা ঘটনাটা স্বামীকে জানায়, কিন্তু সে এটাকে এক প্রাকৃতিক কোনো ব্যাপার বলে ব্যাখ্যা করেবাচ্চাদের অস্তিত্বে উদাসীন হোসে আর্কাদিও কিছুটা এরকমই ছিলো সবসময়, এমন থাকার কারণ শৈশবকে সে মানসিক অপর্যাপ্ততা বলেই মনে করতো আর অন্যদিকে নিজের অবাস্তব কল্পনায় তন্ময় থাকাটাও ছিলো আরেকটা কারণ

কিন্তু সেই বিকেলের পর থেকে, যেদিন সে বাচ্চাদের ডাকলো বাক্স থেকে জিনিসপত্রগুলো বের করতে সাহায্যের জন্য তখন থেকেই বেশীর ভাগ সময় সে ওদের পিছনে উৎসর্গ করতে লাগলোমূল বাড়ি থেকে একটু দূরের সেই কামরাটার দেয়াল ভরে উঠছিল ধীরে ধীরে অবিশ্যাস্য মানচিত্র, আর অলীক সব গ্রাফে, সেখানে ওদের শেখাল পড়তে, লিখতে, গুনতে, সর্বোপরি শেখাল পৃথিবীর বিস্ময়গুলো সম্পর্কে যা কেবল ওর জানা জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না বরং সেগুলো ওর অবিশ্বাস্য কল্পনার শেষ সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো এভাবেই শিশুরা শেখে আফ্রিকার একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে এমন সব বুদ্ধিমান আর শান্তিপ্রিয় মানুষ আছে যাদের বিনোদন হচ্ছে শুধুমাত্র বসে বসে ভাবা অথবা এক দ্বীপ থেকে অন্যদ্বীপে লাফ দিয়ে পার হওয়ার মাধ্যমে ইজিয়ান সাগর পাড়ি দেয়া সম্ভব সালোনিক বন্দর পর্যন্ত সেই সমস্ত ঘোরলাগা বৈঠকগুলো শিশুদের মনের মধ্য এমনভাবে গেঁথে যায় যে, বহু বছর পর পদাতিক বাহিনীর অফিসার ফায়ারিং স্কোয়াডকে গুলি ছোড়ার আদেশের এক মূর্হতে আগে, কর্ণেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া চলে গেল মার্চের সেই নরম বিকেলে যখন ওর বাবা পদার্থবিদ্যায় বিরতি দিয়ে, স্থির চোখে, বাতাসে হাত তুলে মুগ্ধ হয়ে দাড়িয়ে শুনছিল দূর থেকে আসা বাঁশী, ঢোল আর খরতালের জিপসীদের আরও একবার গাঁয়ে আসার শব্দ, আর ঘোষণা করছে মেমফিসের বিজ্ঞ লোকদের আশ্চর্যকর সর্বশেষ আবিস্কারের কথাএরা ছিল নতুন জিপসী দলপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও মহিলার দল শুধু মাত্র কথা বলতে পারে নিজেদের ভাষায়তেলতেলে চামড়া আর বুদ্ধিদীপ্ত হাতের আদর্শ সৌন্দর্যের পুরুষগুলো নাচ আর গান দিয়ে রাস্তায় বপন করেছিলো এক আনন্দময় হট্টগোলের আতংকএদের সঙ্গে ছিলো ইটালিয় গাথাকাব্য আওড়াতে সক্ষম বহুবর্ণে রাঙানো টিয়া পাখী, তামবোরিনের আ্ওয়াজে শতেক সোনার ডিমপ্রসবী মুরগী, মানুষের চিন্তা আঁচ করতে পারা এক প্রশিক্ষিত বাঁদর, একাধিক কাজে সক্ষম যন্ত্র যা দিয়ে বোতাম শেলাই ও জ্বর নামানো যায়, খারাপ স্মৃতি ভুলে যাবার যন্ত্র, সময় ভুলে যাবার বড়িআরও হাজারটা আবিষ্কার, যা এতই উৎভাবনশক্তিসম্পন্ন আর অসাধরণ যে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার খুব ভালো লাগতো যদি ওগুলো মনে রাখার একটা যন্ত্র আবিস্কার করতে পারতোমূহুর্তের মধ্যে গ্রামটা বদলে যায়মাকন্দোবাসীরা হারিয়ে যায় ওদের নিজেদেরই রাস্তায়, মেলার ভীড়ে বিহবল হয়ে

বিশৃংখলার মধ্যে যাতে না হারিয়ে যায়, তাই দুই হাতে দুই ছেলেকে ধরে সোনার দাঁতের কসরৎকারী আর ছয় বাহুর ভেল্কিবাজ, মল আর চন্দন কাঠের দমবন্ধ করা গন্ধের ভিতর, হোঁচট খেতে খেতে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া পাগলের মত সর্বত্র খুঁজছিল মেলকিয়াদেসকে, যাতে করে সে অবিশ্যাস্য দুঃস্বপ্নের গোপন কথাগুলো ব্যাখা দিতে পারেঅনেক জিপসীর কাছেই সে গেল কিন্তু কেউ-ই তার ভাষা বুঝতে পারলো না

অবশেষে সেই জায়গায় সে এলো যেখানে মেলকিয়াদেস তাঁবু গাড়তো আর পেলো এক মৃদুভাষী আর্মেনিয়কে যে কিনা স্প্যানিশ ভাষায় ঘোষণা করছে অদৃশ্য হওয়ার গুনসম্পন্ন এক সিরাপের কথাহোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া দর্শকদের ভীর ঠেলে যখন ওকে প্রশ্ন করতে পারল তখন লোকটা এক ঢোকে পীতাভ রংয়ের এক পদার্থ কেবল মাত্র গলধঃকরণ করেছেজিপসী তাকে এক বিস্ময়াষ্টি দৃষ্টিতে জড়িয়ে ফেলেধোঁয়া ও দুর্গন্ধময় আলকাতরায় পরিণত হওয়ার আগমুহূর্তে তার দেয়া উত্তরের প্রতিধ্বনি সেখানে ভাসসে থাকেঃ মেলকিয়াদেস মারা গেছেএই খবরে কিংকর্ত্যববিমূঢ় হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া অনড় হয়ে থাকে দুঃখটাকে হজম করার জন্যইতিমধ্যে ভীরটা হাল্কা হতে শুরু করেছে অন্য কোন প্রদর্শনী দেখার জন্য আর মিতভাষী আর্মেনিয় সম্পূর্ণরূপে বাষ্প হয়ে গেছেআরও পরে অন্য জিপসীরা তাকে নিশ্চিত করে যে সত্যি মেলকিয়াদেস সিংগাপুরের বালির স্তুপে হার মানে জ্বরের কাছে আর তার দেহ ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে জাভা সমুদ্রের সবচেয়ে গভীর জায়গায়খবরটা বাচ্চাদের কাছে কোনো গুরুত্ব পায় নাওরা বাবাকে তাগাদা দিচ্ছে মেমফিসের বিজ্ঞদের বিস্ময়কর নতুনত্বের সঙ্গে পরিচয় করাতেঢোকার সময়েই তাবু থেকে ঘোষণা করা হয়েছিলো সেটার মালিক ছিল রাজা সোলেমানএত বেশি পীড়াপিরি করে ওরা যে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তিরিশ রিয়ালের বিনিময়ে তাবুর মাঝখানে প্রবেশ করে যেখানে লোমশ শরীর, কামানো মাথা, নাকে তামার নোলক, গোড়ালিতে ভারী শিকল বাঁধা এক বিশাল লোক পাহাড়া দিচ্ছে জলদস্যুদের এক সিন্দুকদৈত্যটা যখন সিন্দুকটাকে খোলে তখন ওটার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক ঠান্ডা প্রবাহওর ভেতর রয়েছে বিশাল স্বচ্ছ একটি টুকরো যাতে অগুনতি সূঁচ বসানো, এগুলো থেকে উষার নির্মলতায় বিক্ষিপ্ত হচ্ছে তারার মতো রং বেরঙের উজ্জ্বলতাবিচলিত, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া জানে যে বাচ্চাগুলো অপেক্ষা করছে শিগগিরই এটার ব্যাখ্যা পাওয়ার জন্য, বুকে সাহস নিয়ে বিড়বিড় করলো সে:

- এটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হিরক খন্ড
- না - জিপসী শুধরে দেয় - এটা বরফ

না বুঝে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া হাত বাড়িয়ে দেয় বরফের টুকরোর দিকেকিন্তু দৈত্যটা হাত সরিয়ে দেয়, “ছোঁয়ার জন্য আরও পাঁচ রেয়াল”– বললহোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তাই দিলবরফের উপর হাত রাখল, ওভাবেই রাখল কয়েক মিনিট আর ততক্ষণে তার বুক ভরে উঠছে ভয় আর রহস্যময় স্পর্শের আনন্দেকি বলবে বুঝতে না পেরে আরও দশ রিয়াল দিল যাতে কোরে বাচ্চারাও এই আশ্চর্য অভিজ্ঞতা অনুভব করতে পারেছোট্ট হোসে আর্কাদিও ছুঁতে অস্বীকার করলঅন্যদিকে আউরেলিয়ানো এক পা বাড়িয়ে হাত রাখল আর সরিয়ে নিল সঙ্গে সঙ্গেএটা বলকাচ্ছে”–চমকে গিয়ে বললকিন্তু ওর বাবার তাতে মনোযোগ ছিল নাসেই সময়ে এই অত্যাশ্চর্যের প্রমাণে মাতাল সে ভুলে গেল তার ব্যর্থ পরিকল্পনার হতাশার কথা আর স্কুইডের ক্ষিধের কাছে পরিত্যক্ত মেলকিয়াদেসের দেহের কথাআরও পাঁচ রিয়াল দিয়ে বরফের উপর হাত রেখে পবিত্র হরফ ছুঁয়ে সাক্ষ্য দেয়ার ভঙ্গিতে বললো- এটা হচ্ছে আমাদের সময়ের মহান আবিষ্কার



পাঁচ ::

যখন জলদস্যু ফ্রান্সিস ড্রেক ষোড়শ শতকে রিওআচা আক্রমণ করে তখন উরসুলা ইগুয়ারানের পরদাদী বিপদ ঘন্টা আর কামানের গোলার শব্দে দিশা হারিয়ে জ্বলন্ত উনুনের উপর বসে পড়েছিলসেই আগুনের ক্ষত তাকে করে দিয়েছিল সারাজীবনের জন্য এক অকর্মা বউসম্পূর্ণভাবে বসতে পারত না, বসত এক পাশে ভর করে, বালিশের সাহায্যেতার হাটাচলায় অজ্ঞাত কিছু একটা ছিলো, যেকারণে সে আর কখনোই জনসম্মুখে হাটেনিগা থেকে পোড়া গন্ধ বের হয়এমন বদ্ধমূল ধারণা থাকায় সব ধরনের সামাজিক কাজ থেকে সে বিরত থাকেভোরবেলাটা আঙ্গিনায় নির্ঘুম তাকে চমকে দিতো, কারন সে দুঃস্বপ্ন দেখত যে ইংরেজরা তাদের হিংস্র কুকুরসহ জানালা দিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে উত্তপ্ত লাল লোহা তার ভেতর লজ্জাজনকভাবে ঢুকিয়ে অত্যাচার করছেস্প্যানিশ ব্যবসায়ী যে-স্বামীর ঔরসে দুই সন্তান রয়েছে সে ঔষধপত্র আর আনন্দফূর্তির পেছনে দোকানের অর্ধেকটা ফতুর করে ফেলে স্ত্রীর ভয় কাটানোর জন্যসবশেষে ব্যবসা লাটে তুলে তাকে নিয়ে গেল সমুদ্র থেকে দূরে পাহাড়ের পাদদেশে এক নিরীহ আদিবাসীদের লোকালয়ে, যেখানে বানালো স্ত্রীর জন্য এক শোবার ঘর, ওটাতে এমন কোনো জানালা ছিল না যাতে করে তার দুঃস্বপ্নের জলসদ্যুরা ঢুকতে পারে

সেই গোপন লোকালয়ে অনেক আগে থেকে বাস করতো দন হোসে আর্কাদি্ও বুয়েন্দিয়া নামের এক আদিবাসী তামাক চাষী যার সঙ্গে উরসুলার দাদীর বাবা এমন এক লাভজনক অংশীদারি ব্যবসা গড়ে তোলে যে কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের ভাগ্য ফেরে
কয়েক শতাব্দী পর সেই আদিবাসীর নাতির নাতি বিয়ে করে স্প্যানিশ নাতনীর নাতনিকেএর ফলে, প্রতিবার যখন স্বামীর পাগলামী উরসুলাকে ক্ষিপ্ত করত তখন সে তিনশ বছরের ঘটনাচক্রের উপর ঝাপিয়ে পরতো, শাপান্ত করত ফ্রান্সিস ড্রেকের বিয়োআচা আক্রমণের সময়টিকেএটা ছিল শুধুমাত্রই মনের ভার লাঘবের একটা উপায়, কারণ আসল কথা হচ্ছে ওরা ছিল আমৃত্যু ভালবাসার চেয়েও শক্ত, অভিন্ন এক বিবেকদংশনে বাধাওরা ছিল জ্ঞাতি ভাই বোনওদের পূর্বপুরুষদের শ্রম আর প্রথা দিয়ে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা প্রাচীন লোকালয়কে প্রদেশের সবচেয়ে ভালো গ্রামগুলোর একটিতে পরিণত করেছিলোযদিও যখন ওরা এই পৃথিবীতে আসে তখন থেকেই ওদের বিয়ে ছিল পূর্ব-নির্ধারিতকিন্তু যখন ওরা পরস্পর বিয়ের ইচ্ছে প্রকাশ করে তখন ওদের নিজেদের আত্মীয়রাই তাতে বাধা দেয়ওদের ভয় ছিল যে দুই বংশের এই স্বাস্থ্যবান জুটি বংশ পরস্পরায় নিজেদের মধ্যে উপর্যুপরি সংকরের ফলে ইগুয়ানার ন্যায় সন্তান জন্ম দিয়ে লজ্জা পেতে পারেএরকম একটা ভয়ংকর উদাহরণ আগে থেকেই ছিলউরসুলার এক খালার বিয়ে হয়েছিল হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার এক চাচার সঙ্গে, জন্ম দিয়েছিল এমন এক ছেলের যে সারা জীবন ফুলানো ও ঢিলে প্যান্ট পরত আর মারা গিয়েছিল বিয়াল্লিশ বছর বয়সে রক্তপাত হয়ে চিরকুমার অবস্থায়কারন জন্ম নিয়েছিল আর বেড়ে উঠেছিল কোমলস্থির এক কুন্ডলীপাকানো লেজ নিয়ে যার ডগায় ছিল বুরুষসদৃশ একগোছা চুলশুকরের এক লেজ যা কিনা কখনোই কোন মেয়েকে দেখতে দেয়নিআর এই লেজের জন্য নিজের জীবন দিতে হয়েছে কারণ যখন এক কসাই বন্ধু অনুগ্রহ করে হাড় কাটার কুঠোর দিয়ে কেটে দিয়েছিল সেটিলঘুমনস্ক উনিশ বছরের হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া এই সমস্যার সমাধান করে দিলো একটি মাত্র বাক্যে শুয়োরের ছানা হলেও কিছু আসে যায় না, যদি নাকি শুধু কথা বলতে পারেএভাবেই বিয়ে করল তিন দিনব্যাপী গানবাজনা আর আতশবাজীপূর্ণ উৎসবের মধ্য দিয়ে উরসুলার মা যদি সবসময় ওদের অনাগত সন্তানের ব্যাপারে অশুভ ভবিষ্যৎবানী না করতো, এমনকি ওদের সহবাস না করার উপদেশ দেয়ার মত চরম পর্যায়ে না যেত তাহলে ওরা সুখেই থাকতশক্ত সামর্থ, স্বেচ্ছাচারী স্বামী ঘুমের মাঝে ধর্ষণ করতে পারেএই ভয়ে উরসুলা শোবার সময় ওর মার হাতে তৈরি প্রাচীনকালের প্যান্ট পড়তো যেটাকে মজবুত করা হয়েছিলো এক ধরনের ফিতে আড়াআড়ি তার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে যেটা বন্ধ করা যেত সামনের দিক থেকে খুব মোটা লোহার বক্লেস দিয়েএভাবেই কাটালো কয়েক মাসদিনের বেলাটা কাটতো লড়াইয়ের মোরগগুলো দেখাশুনা করে আর মায়ের সঙ্গে ফ্রেমে এমব্রয়েডারি করেআর রাতের বেলা কাটাত ঘন্টা কয়েক ব্যগ্র, তীব্র উত্তেজনাময় জোরাজুরি করে যেন সেটা ছিল যৌনমিলনের বিকল্পএই অবস্থা চলতে থাকে যতক্ষন না জনপ্রিয় স্বজ্ঞা গন্ধ পেয়ে যায় যে অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটছে আর গুজব ছড়িয়ে পরে যে বিয়ের এক বছর পরও উরসুলা হচ্ছে কুমারী, কারণ তার স্বামী একটা নপুংসকগুজবটা সর্বশেষ যে ব্যক্তির কানে গিয়ে পৌঁছোয় সে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া
দেখছিস উরসুলা, লোকজন কী বলছে,–স্ত্রীকে বলল খুব শান্তভাবে
ওদের বলতে দাওউত্তর দিলআমরা জানি ওটা সত্য নয়
অবস্থাটা এরকম থাকলো আরও ছয় মাস, অবশেষে এক করুণ রোববারে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া জেতে এক মোরগ লড়াই প্রুদেন্সিও আগিলারের সঙ্গেক্রোধনোমত্ত, পাশবিক উত্তেজনায় হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার কাছ থেকে খানিকটা দূরে সরিয়ে নিলো নিজেকে যাতে সমস্ত গ্যালারি শুনতে পায় যা সে বলতে চায়
তোকে অভিনন্দন-চিৎকার করল,– দেখা যাক শেষ পর্যন্ত এই মোরগ তোর বউয়ের কাজে লাগে কিনাশান্ত হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া নিজের মোরগটা তুলে নিলএখনই ফিরে আসছিসবাইকে উদ্দেশ্য করে বললোপরে প্রুদেন্সিও আগিলারকে লক্ষ করে বলে: আর তুই বাড়ি যা, অস্ত্র নিয়ে তৈরি হ, কারণ তোকে মেরে ফেলবোমিনিট দশেক পর দাদার ধারালো বল্লম নিয়ে সে ফিরে আসেমোরগ লড়াইয়ের যে-জায়গাটায় গ্রামের অর্ধেক লোক জড়ো হয়েছিলো, প্রুদেনসিও আগিলার সেখানেই অপেক্ষা করছিলআত্মক্ষার সময়ও পেল না, প্রথম আ্রউলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যে-নিশানা দিয়ে এলাকার বাঘগুলিকে শেষ করেছিলো ঠিক সেই রকম নিশানা আর ষাড়ের মত শক্তি দিয়ে বল্লমটাকে সে এমনভাবে ছুঁড়ে মারলো যে তা গলা ভেদ করে বেড়িয়ে গেলসেই রাতে যখন মোরগ লড়াইয়ের জায়গায় লাশটার অন্তেষ্টিক্রিয়া হচ্ছে, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ঢুকল শোবার ঘরে, ওর বউ তখন শাস্তির প্যান্টটি পরছে ওটা খোলা”, আদেশ করলউরসুলা স্বামীর সিদ্ধান্তে কোন সন্দেহ প্রকাশ করল না।-যা ঘটবে তার জন্য তুমি দায়ী থাকবেফিসফিস করলোহোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বল্লমটা মাটিতে পুতলো
যদি উগুয়ানারই জন্ম দা্ও, ইগুয়ানাই লালন করব- বলল -কিন্তু তোমার দোষে এই গ্রামে আর কেউ মারা যাবে না
এটা ছিল জুনের এক সুন্দর চাঁদে ভরা ঠান্ডা রাত, জেগেছিল সকাল হওয়া পর্যন্ত বিছানায় লুটোপুটি করে আর অন্যদিকে যে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল শোবার ঘরের ভিতর দিয়ে তা ছিল প্রুদেন্সিও আগিলারের আত্মীয়দের কান্নায় ভারী

ঘটনাটা বিবেচিত হয়েছিল সম্মান রক্ষার দ্বন্দযুদ্ধ হিসেবে, কিন্তু ওদের বিবেকের মধ্যে একটা অস্বস্তি থেকেই যায়এক রাতে ঘুমুতে না পেরে, উরসুলা উঠোনে পানি পান করতে যায় আর দেখতে পায় প্রুদেন্সিও আগিলারকে কলশির পাশেওকে পান্ডুর দেখাচ্ছিলো, অভিব্যক্তি ছিল খুবই করুণ, গলার গর্তটাকে খড় দিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করছেওকে দেখে উরসুলার মনে ভয়ের বদলে করুণারই সৃষ্টি হলোঘরে ঢুকে স্বামীকে বলল যা দেখেছে, কিন্তু সে পাত্তা দিল নামৃতেরা বেরিয়ে আসে নাবলল, “ঘটনা হলো আমরা বিবেকের দংশন সহ্য করতে পারছি নাদুরাত পর, উরসুলা আবার দেখতে পেল প্রুদেন্সিও আগিলারকে গোসলখানায়; গলায় জমাট বাঁধা রক্ত পরিস্কার করছে খড় দিয়েআরেক রাতে দেখল বৃষ্টির মধ্যে সে হেঁটে বেড়াচ্ছেহোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বৌয়ের অলীকদর্শনে উত্যক্ত হয়ে বল্লম নিয়ে উঠোনে বের হলোওখানেই ছিল প্রুদেন্সিও আগিলার তার করুণ অভিব্যক্তি নিয়ে
- জাহান্নামে যা - চিৎকার করল হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, –যতবার ফিরে আসবি ততবারই তোকে মেরে ফেলব