কেবল সেবা নয়, মানুষকে দাও তোমার হৃদয়। হৃদয়হীন সেবা নয়, তারা চায় তোমার অন্তরের স্পর্শ’। এরকম নিছক একটি বাণীই বলে যাননি, আমৃত্যু আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সারাবিশ্বের মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন মহীয়সী নারী মাদার তেরেসা।
সমাজের যারা বিভিন্ন দিক থেকে অবহেলিত, মাদার তেরেসা তাদেরই বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। ৫ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান।
সমাজের যারা বিভিন্ন দিক থেকে অবহেলিত, মাদার তেরেসা তাদেরই বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। ৫ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান।

জন্ম
মাদার তেরেসা রোমান ক্যাথলিক সমপ্রদায়ভুক্ত বিশ্বখ্যাত সমাজসেবিকা। তার জন্ম আলবেনিয়ায় ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট। অটোম্যান সাম্রাজ্যের ইউস্কুবে প্রাথমিক লেখাপড়া সম্পন্ন করেন জন্মশহর স্কেপিয়েতে। তার পুরো নাম আনিয়েজ গঞ্জে বয়াজিউ। ডাক নাম গোস্কসা। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তার বাবা ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। ১৯১৯ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে মাদার তেরেসা পিতৃহারা হন। পিতার মৃত্যুর পর মা তাকে রোমান ক্যাথলিক আদর্শে লালন-পালন করেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি ঠিক করলেন সন্যাসব্রত গ্রহণ করবেন।
১৮ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে একজন মিশনারি হিসেবে সিস্টার্স অফ লোরেটো সংস্থায় যোগ দেন। মা আর দিদিদের সঙ্গে মাদার তেরেসার আর কোনোদিন দেখা হয়নি।
মানব প্রেমের মধ্য দিয়ে আধ্যাত্ম সাধনা
১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একদিন সিস্টার তেরেসা তার ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য খাবার খুঁজতে রাস্তায় বের হলেন। রাস্তায় তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অগণিত মানুষের লাশ। এসব লাশ দেখে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন তিনি। ভয়ে তার শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের আর্তনাদে তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। এরইমাঝে হঠাৎ লরি বোঝাই সেনাদল, সিস্টার তেরেসাকে দাঁড় করালেন এবং তাড়াতাড়ি মঠে ফিরে যেতে নির্দেশ দিলেন। সিস্টার তেরেসা শান্তভাবে তাদের জবাব দিলেন, আমার মঠের তিন শ’ মেয়ের এতটুকু খাবার নেই, তাদের জন্য খাবার চাই-ই। ফৌজির দল সিস্টারের সাহস আর অন্যের প্রতি ভালোবাসা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তারা তখন সিস্টার তেরেসার জন্য চাল সংগ্রহ করে তাকে মঠে পৌঁছে দিলেন।

১৯৫০ সালে কলকাতায় তিনি মিশনারিজ অফ চ্যারিটি নামে একটি সেবাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে মাদার তেরেসা দরিদ্র, অসুস্থ, অনাথ ও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের সেবা করেন। একই সঙ্গে মিশনারিজ অফ চ্যারিটির বিকাশ ও উন্নয়নেও অক্লান্ত পরিশ্রম করেন তিনি।
১৯৫২ সালে মাদার তেরেসা কলকাতা নগর কর্তৃপক্ষের দেয়া জমিতে মুমূর্ষুদের জন্য প্রথম আশ্রয় ও সেবা কেন্দ্র গড়ে তোলেন। ভারতীয় কর্মকর্তাদের সহায়তায় একটি পরিত্যক্ত হিন্দু মন্দিরকে কালিঘাট হোম ফর দ্য ডাইং-এ রূপান্তরিত করেন। এটি ছিল দরিদ্র্যদের জন্য নির্মীত দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র। পরবর্তীতে এই কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে রাখেন নির্মল হৃদয়। এই কেন্দ্রে যারা আশ্রয়ের জন্য আসতেন তাদের চিকিৎসা সুবিধা এবং সম্মানের সাথে মৃত্যু বরণের সুযোগ করে দেয়া হয়। মুসলিমদের কুরআন পড়তে দেয়া হয়, হিন্দুদের গঙ্গার জলের সুবিধা দেয়া হয় আর ক্যাথলিকদের প্রদান করা হয় লাস্ট রাইটের সুবিধা। এ বিষয় তেরেসা বলেন, "A beautiful death is for people who lived like animals to die like angels — loved and wanted."
তেরেসার এই মানবসেবা বা মিশনারি কার্যক্রম প্রথমে ভারত অতিক্রম করে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮২ সালে বৈরুত অবরোধের চূড়ান্ত প্রতিকূল সময়ে মাদার তেরেসা যুদ্ধের একেবারে ফ্রন্ট লাইনের হাসপাতালে আটকে পড়া ৩৭ শিশুকে উদ্ধার করেন। সমাজতান্ত্রিক শাসনের সময়ে পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশেই মিশনারি কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছিল। এ সময়েই মাদার তেরেসা মিশনারিস অফ চ্যারিটির কাজ পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন।

মাদার তেরেসা ইথিওপিয়ার ক্ষুধার্তদের কাছে যেতেন, ভ্রমণ করতেন চেরনোবিল বিকিরণে আক্রান্ত অঞ্চল। আমেরিকার ভূমিকম্পে আক্রান্তদের মাঝে সেবা পৌঁছে দিতেন। ১৯৯১ সালে মাদার তেরেসা প্রথমবারের মতো মাতৃভূমি তথা আলবেনিয়াতে ফিরে আসেন। এদেশের তিরানা শহরে একটি ‘মিশনারিস অফ চ্যারিটি ব্রাদার্স হোম’ স্থাপন করেন।
১৯৯৬ সালে পৃথিবীর ১০০টিরও বেশি দেশে মোট ৫১৭টি মিশন পরিচালনা করছিলেন তিনি। মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে যে চ্যারিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল— সময়ের ব্যবধানে তা কয়েক হাজারে পৌঁছায়। তারা সবাই বিভিন্ন দেশের প্রায় ৪৫০টি কেন্দ্রে মানবসেবার কাজ করে যাচ্ছিলেন।
স্বীকৃতি
গত শতাব্দের সত্তরের দশকের মধ্যেই সমাজসেবী ও অনাথদের বন্ধু হিসেবে মাদার তেরেসার খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পরে ১৯৭৯ সালে তিনি তার সেবাকার্যের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। আর ১৯৮০ সালে ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরতœ লাভ করেন।
মৃত্যু
১৯৮৩ সালে পোপ জন পল ২ এর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রোম সফরের সময় মাদার তেরেসার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। ১৯৮৯ সালে আবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর তার দেহে কৃত্রিম পেসমেকার স্থাপন করা হয়। ১৯৯১ সালে মেক্সিকোতে থাকার সময় নিউমোনিয়া হওয়ায় হৃদরোগের আরও অবনতি ঘটে।

মৃত্যুর পর পোপ দ্বিতীয় জন পল তাকে স্বর্গীয় আখ্যা দেন। এবং তিনি কলকাতার স্বর্গীয় টেরিজা নামে পরিচিত হন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন