বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

এক কামরার ঘর (অনুবাদ গল্প)

ইউসুফ ইদ্রিস (জন্ম:১৯২৭, মৃত্যু:১৯৯১) আরবী ভাষার সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে অন্যতম একজন। মিশরীয় এই ছোট গল্পকার ও নাট্যকার পেশাগত জীবনে একজন চিকিৎসক ছিলেনকট্টর বামপন্থী এই লেখক তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের কারণে জেলও খেটেছেনতাঁর লেখায় সমন্বয় ঘটেছে প্রচলিত আখ্যানরুপের সঙ্গে চলিত কথনের, ফুটে উঠেছে সাধারণ গ্রাম্য জীবনের বাস্তবতাঅনুদিত ‘A House of Flesh ‘ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের এক গল্প সংকলনেমোনা মিখাইলের ইংরেজী অনুবাদ অনুসরণে লেখাটি বাংলায় তর্জমা করেছেন রেশমী নন্দী। 

নিস্তব্দতা নিয়ে এ গল্প শুরুপঁয়ত্রিশ বছর বয়সী লম্বা, ফর্সা, লাবণ্যময়ী এক বিধবা আর তাঁর তিন মেয়ে, গড়নে লম্বা তবে মোটা গোছেরদিনের পর দিন, অনেকদিন তারা সবাই ক্রমাগত কালো রঙের শোকের পোশাক পরে আছেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটজনের বয়স ষোল আর বড়জন বিশের কোঠায়বাবার মতোই মেয়েরা সবাই কালো, বিসদৃশ দেহাবয়বধারি, স্থুলকায়, থলথলে- মায়ের গড়নের প্রায় কিছুই পায়নি তারাসারাটা দিন এক কামরার বাসাতেই তাদের দিন কাটেচরম অভাবের মধ্যেও মেয়েলি ছোঁয়ার গুণে তাদের এক কামরার ঘরটা ছিমছাম, আরামদায়করাত নেমে এলে এ ঘরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে চারটা শরীরবিছানায়, আরামকেদারায় গড়াগড়ি খেতে থাকে উষ্ণ জীবন্ত মাংসের পিন্ডগুলো- ঘুমহীন রাত ঘন নিঃশ্বাসের শব্দে ভারী হয়ে ঝুলে থাকে ঘরে

দীর্ঘ রোগভোগের পর এ বাড়ির একমাত্র পুরুষ সদস্য মারা যাওয়ার পর থেকেই শব্দহীনতায় ডুবে আছে এ ঘর, তবে সেও প্রায় দুবছর হলোশোকের বাঁধা সময় পার হয়েছে অনেক আগেই, কিন্তু শোক করার অভ্যাস কাটেনি, বিশেষ করে চুপচাপ থাকার এ প্রবণতাআদপে এ একধরনের প্রতীক্ষামেয়েদের বয়স বাড়ছে কিন্তু কোন পাণিগ্রাহী এ পথ মাড়াচ্ছে নাকে-ই বা দেখতে খারাপ, সেই সাথে এতিম এমন মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে? কিন্তু আশা মরে না (সঠিক ক্রেতার জন্য সুরার অপেক্ষা স্বতঃসিদ্ধ)মেয়েরা আশা করে বসে আছে একদিন ভাগ্য বদলাবেতারা যতই গরীব হোক, তাদের চেয়েও গরীব নিশ্চয় কেউ আছেআর চেহারার কথাই যদি ধরা হয়, তাদের চেয়েও কুৎসিত মানুষের অভাব নেইসবচেয়ে বড় কথা, ধৈর্য্য ধরলে স্বপ্ন একদিন পূরণ হবেই

স্থায়ী এ নৈঃশব্দ ভেঙ্গে মাঝে মাঝে আবেগহীন একঘেয়ে গলায় এ বাড়িতে কোরান তেলাওয়াতের সুর শোনা যায়অন্ধ এক তেলাওয়াতকারী মৃতের আত্মার বেহেস্তবাস কামনা করে প্রার্থনা করেপ্রত্যেক শুক্রবার তার লাঠি এ বাড়ির দরজায় আওয়াজ তোলেকেউ একজন তখন হাত বাড়িয়ে তাকে ভিতরে নিয়ে আসেমাদুরে হাঁটু মুড়ে বসে শুরু হয় কোরান তেলাওয়াতপ্রার্থনা শেষে হাতড়ে হাতড়ে জুতা জোড়া খুঁজে নিয়ে সালাম জানিয়ে বিদায় নেয় সেকেউ তাকে স্বাগত কিংবা বিদায় জানায় নাঅভ্যাসবশতঃ সে আসে, কোরান পাঠ করে আর চলে যায়তার উপস্থিতি পর্যন্ত কেউ লক্ষ্য করে না
flesh.gif
এ ঘরের অনতিক্রম্য নৈঃশব্দ কোরানের সুরেও বিচলিত হয়নাসম্ভবতঃ কেবল নীরবতার চাপেই চেপে বসা নীরবতার অবসান সম্ভবঅপেক্ষা আশার মতোই চিরন্তনতুচ্ছ মানুষও বাঁচে নিয়ত আশায়, তা যতই অকিঞ্চিতকরই হোক না কেনতুচ্ছের চেয়েও তুচ্ছতর কেউ না কেউ থাকেইআর মেয়েদের স্বাভাবিক এ চাওয়াকে উচ্চাকাঙ্খা বলা যায় না

এভাবেই দিন কেটে যেত যদি না সেই শুক্রবারও অন্ধ তেলাওয়াতকারী যথারীতি এ বাসায় আসতোসব কিছুরই শেষ আছে, দেখা যাচ্ছে এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছেসেদিনই প্রথমবারের মতো মা ও মেয়েরা বুঝতে পারলো, সপ্তাহের অন্তত একটা দিন একজন পুরুষের গলা এ বাড়িতে শোনা যেত এতদিনআর এরমধ্যে এ লোকই একমাত্র পুরুষ যে এ বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়েছেতাদের হঠাৎ বোধদয় হলো যে গরীব হলেও তার পরিচ্ছন্ন পোশাক, চকচকে জুতা আর নিখুঁত পাগড়ির বাঁধন যেকোন দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষকে লজ্জা দিতে পারেআর তার চেয়েও বড় কথা, তার আছে তেজদীপ্ত, গভীর, সুরেলা কন্ঠস্বরতাদের মনে হতে থাকলো যে এখনই তাকে ডেকে এনে চুক্তি নবায়ন করা উচিৎতিনি কি অন্য কোথাও ব্যস্ত থাকবেন? সে যাই হোক, তারা অপেক্ষা করতে পারবেঅপেক্ষা করার অভ্যাস তাদের আছে

সন্ধ্যা শেষ হয়ে এসেছেতিনি কোরান পাঠ করছেন যেন প্রথমবার তারা শুনছেতারা ভাবতে শুরু করলো, যার গলার স্বর এ ঘর ভরিয়ে রাখে, তাদের মধ্যেই কারো একজনের তাকে বিয়ে করে ফেলা উচিৎ

সদ্য গোঁফ উঠা অবিবাহিত এক যুবক তিনিকথায় কথায় জানা গেছে তিনিও বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রীর সন্ধানে আছেনমেয়েদের আলোচনা থেকে এ কথা জেনে মা মেয়েদের মুখের দিকে তাকায়বোঝার চেষ্টা করে, এদের মধ্যে ভাগ্যবান কোনজন? কিন্তু মায়ের চোখে চোখ না রাখা চেহারাগুলো যেন বলতে থাকে, “আমাদের দীর্ঘ প্রতিক্ষার এই কি প্রতিদান? আমাদের এতদিনকার অপেক্ষার প্রাপ্তি একজন অন্ধ পুরুষ?” তারা তখনো স্বপ্ন দেখছিলো সত্যিকারের একজন স্বামী পাওয়ারআর স্বামী মানেই দৃষ্টিসম্পন্ন যুবকবেচারা, তাদের এখনো পুরুষদের জানতে বাকি আছেতাদের পক্ষে এই বয়সে বোঝা সম্ভব নয় যে কেবলমাত্র চোখের আলো থাকাটাই একজন পুরুষের যথেষ্ট যোগ্যতা নয়

মা, তুমি উনাকে বিয়ে করো
আমি? কি লজ্জা! লোকে কি বলবে?”
যার যা ইচ্ছে বলুকএকেবারে অভিভাবকহীন ঘরের চেয়ে ঢের ভালো এমন এক ঘর, যেখানে অন্তত পুরুষকন্ঠ বাজে
তোদের ফেলে আমি বিয়ে করবো? অসম্ভব
সেটাই তো ভালো হবেএরপর আরো অনেক পুরুষদের এ বাসায় আসার সুযোগ হবেআমাদেরও তখন বিয়ে হবেউনাকে তুমি বিয়ে করো মাও মা, বিয়ে করো উনাকে

তারপর, তাদের মা বিয়ে করলোএক কামরার ঘরে আরো একজনের নিঃশ্বাস যুক্ত হলোপরিবারের আয় কিছুটা বাড়লেও এবার বড় এক সমস্যা দেখা দিলোপ্রথম রাত কোনভাবে পার হলো কিন্তু ভুল করেও নবদম্পতি কাছাকাছি হলো নাযদিও মেয়েরা ঘুমিয়ে ছিলো কিংবা ঘুমের ভান করে ছিলো, কিন্তু মা স্পষ্ট টের পেল কয়েক জোড়া চোখ তাদের মধ্যকার দূরত্ব মাপছপুরো অস্তিত্ব দিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা চলছে এখানেদাম্পত্য সম্পর্কের মানে বোঝার পক্ষে মেয়েরা যথেষ্ট বড় হয়েছেহঠাৎ করেই পুরো ঘরটা যেন সংবেদনশীল কিছু একটাতে পরিণত হয়েছেযেন রাতের অন্ধকারেও পুরো ঘর আলোকিত

সকালবেলা এক এক করে মেয়েরা ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলোসন্ধ্যা নামতেই এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে ইতঃস্তত পায়ে ঘরের কাছাকাছি আসতেই তারা শুনতে পেলো, তাদের ফেলে যাওয়া ঘরজুড়ে হাসি, মাঝে মাঝে অস্পষ্ট মেয়েলি কন্ঠ শোনা যাচ্ছেনিশ্চয় মা আর তাদের সেই চেনাজানা সম্মানিত তেলাওয়াতকারীমেয়েদের দেখে মা তাদের দিকে এগিয়ে এলো- ভেজা খোলা চুল, হাতে ধরা চিরুনি, তখনো হাসছিলোতারা মায়ের মুখের দিকে তাকায়যেন অনেকদিন ধরে নিভে থাকা এক প্রদীপ, যার কোনায় ঝুল জমেছিলো, এখন আলোকিতজ্বলজ্বলে চোখে হাসির আভাসেদিন থেকে তাদের জীবন থেকে নিস্তব্দতা নির্বাসিত হলোরাতের খাবার সময়টা হৈ হৈ করে কাটলোতেলাওয়াতকারী তার সুরেলা কন্ঠে উম্মে কুলসুম ( হযরত মোহাম্মদের চার মেয়ের তৃতীয়জন ) আর আব্দুল ওহাবের ( ইসলামি শিক্ষাবিদ) অনুকরণ করে শুনিয়ে তাদের সবাইকে একেবারে মাতিয়ে রাখলো

এই তো চাইখুব শীঘ্রি এই হাসির শব্দ, এই ফূর্তি অন্য পুরুষদেরও আকর্ষন করবে
বিশ্বাস রাখো মেয়েরাখুব তাড়াতাড়ি পুরুষদের আগমন শুরু হবে আর বিবাহপ্রার্থীদের আগ্রহও প্রকাশ পাবেকিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মায়ের মন তখন ডুবে ছিলো যুবক স্বামীর স্বপ্নেলোকটা অন্ধ, কিন্তু চোখ থাকতেও তো আমরা প্রায়ই অন্যদের দিকে তাকাই নামানুষটার উপচে পড়া প্রাণশক্তির জোয়ার মায়ের এতবছরের অসুস্থতা, পুরুষত্বহীনতা আর অকাল বার্ধক্যের স্মৃতি ভাসিয়ে দিয়েছে

নিস্তব্দতাকে নির্বাসিত করে জীবনের স্পন্দন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক কামরার এ বাসায়
ধর্মমতে তাদের বিয়ে হয়েছে, তারা এখন বৈধ স্বামী-স্ত্রীএখন আর কিছুই মাকে লজ্জিত করে নাকোন কিছুই গোপন নয়, তেমন চেষ্টাও নেইএক কামরার বাসায় রাত নেমে আসে, গাদাগাদি করে এক কামরাতেই সবকটা মানুষএকসময় শরীরের দাবিতে দম্পতির শরীর আর আত্মার মিলন ঘটেহয়তো মেয়েরা তখন সজাগ নিদ্রায় অস্বিস্তহীন, দীর্ঘনিঃশ্বাস আর গোঙ্গানি চাপার চেষ্টা করছে

মায়ের দিন কাটে বড়লোকদের বাড়িতে কাপড় কেচে, মায়ের স্বামী দিনমান গরীবলোকদের ঘরে ঘরে কোরান তেলাওয়াত করে

প্রথম দিকে দুপুরবেলা লোকটা বাসায় ফিরতো নাকিন্তু রাতের ক্লান্তি কাটাতে, রাতের জন্য প্রস্তুত হতে ইদানিং তার বিশ্রাম নেবার দরকার হয়

দম্পতির কয়েকটা রাত আনন্দে কেটে গেলোএকরাতে হঠাৎ লোকটা জিজ্ঞেস করলো, দুপুরবেলা তার কি হয়েছিলোএখন এত কথা বলছে অথচ দুপুরে একেবারে চুপচাপ ছিলো কেন? এখন বিয়েতে উপহার দেয়া আংটি পড়েছে অথচ দুপুরে ওটা হাতে ছিলো না কেন?

এমন হতে পারতো যে একথা শোনা মাত্র মা উন্মাদের মতো চেঁচিয়ে উঠেছে, কান্ডজ্ঞান হারিয়ে লোকটাকে খুন করেছেকারন, যা সে শুনলো, এর কেবল একটি অর্থই হতে পারেনির্মম, ভয়াবহ এক অর্থকিন্তু একটা ঢোক গিলে উন্মত্ত কান্না ঠেলে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেকে শান্ত করে রাখলো সেঅন্ধকারে কান দিয়ে হাসিল করতে চাইলো শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কাজ, বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো, কে সেই অপরাধী? কেন যেন মনে হচ্ছে, এ মধ্যম জনের কাজভয়ঙ্কর ধারালো হয়ে উঠেছে ইদানিং ওর চোখতবু মা নিশ্চিত হবার জন্য কান পেতে থাকলোতিন মেয়ের ঘন ভারি নিঃশ্বাসের অনিয়মিত শব্দ টের পাওয়া যাচ্ছেযৌবনের স্বাভাবিক আকাঙ্খা গোঙানির শব্দে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, যেন আগুনের হল্কা, যেন উত্তপ্ত লাভা বেরিয়ে আসবে তৃষ্ণার্ত ভূমি ফুঁড়েমায়ের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, গলায় ঠেকছে একটা কান্নার ডেলানিজের সন্তানদের মা এখন আর আলাদা করে চিনতে পারছে না- সবকটা মানুষি একাকার হয়ে গেছে কামনার উত্তাপেসবারই শরীর জুড়ে ক্ষুধাসন্তানদের নিঃশব্দ এ বিলাপ হাহাকার নয়, যেন মায়ের কাছে আকুতি, সানুনয় প্রার্থনা কিংবা হয়তো তারও চেয়ে বেশি কিছু


এতদিন মা নিজের ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্তিতে মগ্ন থেকেছেসন্তানদের প্রতি দায়িত্বের কথা তার মনে ছিলো নাতার মেয়েদের কাছে অপেক্ষা এখন তেতো লাগছে, পরিণয় আকাঙ্খা মরিচীকার মতো উবে গেছেহঠাৎ করেই যেন মার খেয়ে কিংবা ভেতরের গোপন কোনো ডাকে ওরা জেগে উঠেছেআকাঙ্খার বস্তু নিষিদ্ধ কিন্তু আকাঙ্খা যে এখানে আরো বড়ো পাপএ ক্ষুধাকে মা খুব ভালো করে চিনেকতদিন আত্মার উন্মিলনে রক্তেমজ্জায় এ ক্ষুধা নিজেকে জাহির করেছে তার কাছেযে তৃপ্তি নিয়ে সে এখন পূর্ণ, তাকে ভোলা তো তার পক্ষে অসম্ভব

ক্ষুধার্ত সন্তান! মা হিসেবে নিজের মুখের খাবার তুলে দিয়ে সারাজীবন সন্তানদের ক্ষুধা মিটিয়েছে সে, নিজের কথা তো কখনো ভাবেনিআর আজ? সে যে মা, একথা কি করে ভুলে যাবে সে?

এরপর সেই রাতে আর কোনো অনুরোধই তাকে জাগাতে পারলো নাবেদনা জমাট বেঁধে পরিণত হয়েছে নিস্তব্দতায়মা সেদিন থেকে একেবারে চুপচাপ হয়ে গেলোপরেরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে দেখা গেলো ঠিক তার ভাবনানুযায়ি মেজো মেয়েও চুপচাপমা আর মেয়ে এরপর থেকে নিস্তব্দতাতেই আশ্রয় নিলোরাতে খাবার সময় অন্ধ কর্তা খুশিতে ডগমগ, গান গাইছে, হাসছে, কিন্তু আজ কেবল বড় আর ছোট মেয়ে এ আনন্দের সাথে তাল মিলালো

ধৈর্য্য পরীক্ষার তিক্ততা অসুস্থ করে তুলেছে মেয়েদের কিন্তু তখন পর্যন্ত কোন পাণিপ্রার্থির দেখা নেইএকদিন হঠাৎ বড় মেয়ে মায়ের বিয়ের আংটির দিকে তাকিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেমায়ের হৃদয় কেঁপে উঠলোহৃদস্পন্দনের তুমুল ডামাডোলের ভিতর দিয়ে মা শুনতে পেলো, বড় মেয়ে কেবল একটা দিনের জন্য তার কাছে আংটিটা চাইছেমা চুপচাপ আংটিটা খুলে মেয়ের হাতে দিয়ে দেয়মেয়েও আর কোন কথা না বলে আংটিটা হাতে পড়ে নেয়

সেই সন্ধায় বড় মেয়েও একেবারে চুপচাপ হয়েছিলোএবং সেদিন অন্ধ কর্তার আনন্দ হুল্লোড়ে কেবল ছোট মেয়েকেই আগ্রহী দেখা গেলো

অপেক্ষা করতে করতে ছোট মেয়েটাও বড় হয়ে উঠলো কিন্তু ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হলেন নাএবং একদিন এ খেলায় যখন সে নিজের জায়গা চাইলো, তখন কোথাও কোন আলোড়ন না তুলেই সে এর অংশ হয়ে গেলো

আংটিটা প্রদীপের পাশেই পড়ে থাকেচারপাশ চুপচাপকান পর্যন্ত কিছু জানতে পারে নাএর মধ্যে যখন যার পালা আসে আংটিটা হাতড়ে নিয়ে আঙুলে ঢুকিয়ে নেয়আর তারপর আলোটা নিভে যায়

অন্ধকারের রাজত্বে দৃষ্টিবানরাও অন্ধে পরিণত হয়কেবল অন্ধ যুবকের আনন্দ ফুরোয় নাকিন্তু তবু তার হৈচৈ আর আনন্দের ভেতরেও এখনকার নিস্তব্দতা তাকে তাড়া করে ফেরেঅনিশ্চয়তার অনুভব তাকে অস্বস্তিতে ফেলেশুরুতে তার মনে হয়েছিলো, এমন ক্ষণে ক্ষণে বদলানো মেয়েদের স্বভাবকখনো সে ভোরের শিশিরের মতো তরতাজা, অন্যসময় জলাবদ্ধ ঘোলাটে জলকখনো গোলাপের পাপড়ির মতো মসৃণ, আবার কখনো ক্যাকটাসের কাঁটাময় শরীরযদিও সবসময়ই আংটিটাকে আঙুলেই খুঁজে পায় সে, কিন্তু আঙুলটাকে এক এক সময় এক এক রকম লাগেযুবক মোটামুটি নিশ্চিত যে সবাই সবকিছু জানেতাহলে এ নীরবতার অর্থ কি? খাবার খেতে বসে নিছক এ ভাবনাতেই তার গলায় রুটি আটকে যায়এবং সেই মুহূর্ত থেকে আর একটাও কথা শোনা যায় না সেখানেএরপর থেকে সবকিছু ভেঙে পড়ার আশংকা নিয়ে তার দিন কাটতে থাকেএবারের শব্দহীনতার অর্থ ভিন্ন, সচেতন এ নীরবতার কারন দারিদ্র নয়, অপেক্ষা নয়, হতাশা নয়, এ নীরবতা আরো গভীর কিছু ধারণ করে আছেকোনরকম আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছাড়াই কেবল শব্দহীনতার জালেই তারা সবাই বাঁধাযুবতী বিধবা, তার তিন মেয়ে, এক কামরার একটা ঘর আর এক নতুন ধরনের নিস্তব্দতাঅন্ধ তেলাওয়াতকারীর সাথে সাথে নিস্তব্দতাও এখন এই ঘরের বাসিন্দাএ নিস্তব্দতায় যুবক আশ্রয় খোঁজেভাবে, তার বৈধ স্ত্রীই তার শয্যাসঙ্গী, যদিও এক এক দিন এক এক রকম শরীর, কিন্তু তার দেয়া আংটি থাকে তার আঙুলেযুবতী কিংবা বৃদ্ধ, মসৃণ অথবা এবড়োথেবড়ো, কখনো মোটা, কখনো ছিমছিমে, এ নিয়ে তার ভাবার কোন দায় নেইযাদের চোখ আছে, ভাবতে হলে তারা ভাবুক

যাদের দৃষ্টি আছে তারাই তো কেবল নিশ্চিত হতে পারে, ন্যায় অন্যায় বিচারের ভারও তাদেরই উপরদৃষ্টিহীনতা নিয়ে সে কেবল সন্দেহই করতে পারে যে সন্দেহ কেবল দৃষ্টিবানদের পক্ষেই মিটানো সম্ভবযতক্ষন সে দৃষ্টিহীন, ততক্ষন নিশ্চিত হবার কোন দায় তার নেইঅন্ধের আবার লজ্জা কিসের? নাকি তাদেরও লজ্জা পাবার কথা!

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন