ভৌগলিক, রাজনৈতিকসহ নানা দিক থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। তাই ভারতের ন্যায় বাংলাদেশের জনগণও অধীর অপেক্ষায় ছিল ভারতের নির্বাচনী ফলাফলের। অনেকেরই ধারণা, ভারতে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশ সরকারেও নীতিগত অনেক বিষয়ে পরিবর্তন আসবে। বিরোধী দলের আন্দোলনের পালেও লাগতে পারে নতুন হাওয়া।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে ইতিপূর্বে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের এতো কঠোর এবং আত্মবিশ্বাসী মনোভাবের পাথেয় যুগিয়েছে ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস। বিশেষ করে গত ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের মতো কঠিন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে অকুণ্ঠভাবে সমর্থন জানিয়েছে কংগ্রেস। আর সেই সমর্থনের বলেই শেখ হাসিনা সারাবিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্ষমতার মসনদ পাকাপাকি করেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি বিপুল জনসমর্থন থাকা সত্বেও সরকার বিরোধী আন্দোলনে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। এছাড়া প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সাথে রয়েছে বাংলাদেশের ভৌগলিক, প্রাকৃতিক, বাণিজ্যিকসহ নানা হিসাব-নিকাশ। বিশেষ করে সীমান্ত সমস্যা, পানির ন্যায্য হিস্যা, ট্রানজিট, করিডোর, সিটমহলসহ নানা অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে দেশ দুইটির মধ্যে।
শুক্রবার সকালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার শুরুতেই সরকার পরিবর্তনের আভাস পরিষ্কার হয়ে যায়। সেই সাথে সবাই অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে মোদিই হচ্ছেন- ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকে স্বাগত জানিয়েছেন ভারতের কংগ্রেস প্রধান সোনিয়া গান্ধী, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুভেচ্ছা জানিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়া, বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা।
এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ জাস্ট নিউজকে বলেন, ভারতে বহুবছর পর ক্ষমতার রাজনীতিতে পরিবর্তন আসায় এর কিছুটা প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে। আমরা আশা করছি, ভারতের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এ অঞ্চলের উন্নয়নে ও সমস্যার সমাধানে একটা দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে।
তবে বাংলাদেশে গত ৫ জানুয়ারি একটা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের সাথে তাদের মনস্তাত্তিক দূরত্ব কিছুটা থাকবেই। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, এর মাধ্যমে হয়তো আমরা একটা মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিকেও এগিয়ে যেতে পারি। সবকিছুই নির্ভর করছে বিএনপির রাজনীতির উপর।
তিনি মনে করেন, বিজেপির জয়ে ভারতের সাথে ঝুলে থাকা পানিসহ ভৌগলিক সব সমস্যার আশু সমাধানে হয়তো পৌঁছানো সম্ভব হবে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত মোদি সরকার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী মনমোহন সরকারের চেয়ে বেশি স্বাধীন ও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। সেহেতু এ অঞ্চলের বিবাদমান সমস্যাগুলোর সমাধানে একটা দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে বলেই আশা করছি।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমাজ উদ্দিন আহমেদ জাস্ট নিউজ’কে বলেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়েই এগোতে হবে। তবে ভারতের ক্ষমতার রাজনীতিতে পরিবর্তনে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে তা নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
তিনি বলেন, বিজেপির আদর্শগত অবস্থানের কারণে এবং ইতোপূর্বে মোদির বিভিন্ন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এখনই স্পষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয় যে তাদের ক্ষমতার পালাবদলে নীতির বদল কতটুকু হবে। আর বাংলাদেশ লাভবানইবা কতটুকু হবে।
তিনি বলেন, কিছুদিন যাক, রাষ্ট্র পরিচালনায় ওদের পলিসিগুলো কী হয় তা আগে দেখতে হবে। এরপর বলা যাবে বাংলাদেশের সাথে ভারতের ভবিষ্যত সম্পর্ক কেমন হতে পারে।
ভারতের নির্বাচনে বিজিপি বিপুল সিটে কংগ্রেসকে পরাজিত করেছে, এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেমন প্রভাব ফেলবে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক আহমেদ চৌধুরী জাস্ট নিউজকে বলেন, ভারতের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশীদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের অনেক অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেমন ভারতের ভূমিকা থাকে তেমনি ভারতের অভ্যন্তরীণ অনেক কিছুর সঙ্গে বাংলাদেশের ভূমিকা চলে আসে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে বড় একটি দল অংশ নেয়নি। এতে করে অনেকের কাছেই অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। তাই আমি মনে করি, ভারতের এ ক্ষমতাবদল পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা নতুন কিছু আনলেও আনতে পারে।
তবে সবকিছু নির্ভর করছে বিজেপি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক দক্ষতার উপর। এখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটা বড় ভূমিকা থাকবে বলেও মনে করেন সাবেক এ কূটনীতিবিদ।
দেশে-বিদেশে কূটনৈতিক মিশনগুলো দায়িত্ব পালন করা এ রাষ্ট্রদূত বলেন, অনেক বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের একটা বোঝাপড়ার অভাব ছিল গত কয়েকটি বছরে। সে জন্য তিস্তার পানিসহ কয়েকটি বিষয়ে ঝুলে ছিল। বিজেপি’র এ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা হয়তো এ সমস্যাগুলোর সমাধান এনে দিতেও পারে।
দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশি মিশনগুলোতে দায়িত্বে থাকা কূটনীতিক এফ এ শামিম আহমেদ জাস্ট নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা প্রভাবতো অবশ্যই পড়বে। তবে তা কতটুকু সেটা দেখার বিষয়।
তিনি বলেন, কোনো সরকার যখন অন্য দেশের নতুন একটা সরকারের সঙ্গে কাজ করে তখন নীতিগত, দর্শনগতভাবে অনেক নতুন বিষয়েরই দেখা মেলে। এটা যে কোন দেশের সঙ্গেই হতে পারে।
বিএনপি ভারত সরকারের এ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কোনো সুবিধা আদায় করতে পারবে কিনা তা জানতে চাইলে সাবেক এ কূটনীতিক বলেন, এটা বিএনপি’র কৌশলের উপর নির্ভর করে। এখন সরকার যদি ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ার বিষয়টা দ্রুত করে নিতে পারে তাহলে বিএনপি সুযোগ নিতে পারবে না বলেও মনে করেন তিনি।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ভারতের সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে কিছু কিছু বিষয়ে বাংলাদেশ লাভবান হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। তবে তাদের ধর্মীয় মনোভাবের কারণে সম্পর্কে হয়তো কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, বিজেপির অতীত ইতিহাসে দেখা যায়, তারা গত দুই টার্ম যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন বাংলাদেশ ফারাক্কায় চুক্তি অনুযায়ী সঠিক পরিমাণে পানি পেয়েছিলো, তিস্তার পানিরও ন্যায্য হিস্যা পাওয়া গেছে। কিন্তু যখন কংগ্রেস ভারতের ক্ষমতায় এসেছে, তখন সেসব বন্ধ করে দেয়।
তিনি বলেন, এসব ক্ষেত্রে যদি বিজেপি তাদের আগের অবস্থান ঠিক রাখে তাহলে বিএনপির সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো থাকবে।
ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, কিন্তু বিজেপি বা নরেন্দ্র মোদি কট্টর হিন্দুত্ববাদী হওয়ার কারণে সব সময় এন্টি মুসলিম মনোভাব পোষণ করেন। অতীতে দেখ গেছে, ভারতে যতগুলো দাঙ্গা হয়েছে তার বেশিরভাগেই নরেন্দ্র মোদির নাম উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে তারা যদি তাদের আগের মনোভাবের পরিবর্তন না করেন, তাহলে বিএনপির সাথে সম্পর্ক হয়তো ভালো যাবে না।
তিনি বলেন, আমরা আশা করছি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত মোদি সরকার পাশ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করবে। আমাদের দাবি অনুযায়ী তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাব। সকল অমীমাংসিত চুক্তিগুলোর বাস্তবায়ন হবে।
বিজেপির ক্ষমতায়নে বিএনপির রাজনীতিতে কৌশলগত কোনো পরিবর্তন আসছে কিনা এমন প্রশ্নে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, গত ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। এদেরকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক সরকার বলা যায় না। আর ভারত যেহেতু বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সে হিসেবে ভারত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনে কিছুটা চাপ প্রয়োগ করতেই পারে। আর এমটা যদি হয়, তাহলে আমাদের আন্দোলন কৌশলেও হয়তো পরিবর্তন আসতে পারে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদ বলেন, ভারতের নতুন সরকার তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে লক্ষণীয় পরিবর্তন আনলেও আমি মনে করি বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন পরিবর্তন হবে না। রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারত একটি স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছেছে তাই এখানে হঠাৎ কোনো পরিবর্তন আশা করা যায় না।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক আমেনা মহসিন বলেন, এ বিজিপি আদভানি বা বাজপেয়ীর না, এটা নরেন্দ্র মোদির বিজেপি। যার আমলে গুজরাটের মতো গণহত্যা ঘটেছিল। এ নরেন্দ্র মোদি অত্যন্ত কট্টরপন্থী। তাই এ ধরনের লোক যখন ক্ষমতায় থাকে তখন পররাষ্ট্রনীতির প্রক্রিয়ার মধ্যেই একটা পরিবর্তন আসে।
(জাস্ট নিউজ/এএইচ/এলএ/২২৪৯ঘ.)