আকতার হোসেন : নিজেদের অবৈধ ক্ষমতা ধরে রাখতে সরকার তালিকা করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। গত ১৫ দিনের চলমান আন্দোলনে কেবল মাত্র পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের গুলিতে অন্তত ১১ জন বিরোধীদলীয় নেতা নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় দেশের সুশীল সমাজ ও পেশাজীবীসহ সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
তথ্যমতে, ‘৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবসে’র কর্মসূচিকে ঘিরে গড়ে ওঠা চলমান আন্দোলনে দেশের বিভিন্নস্থানে পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের গুলিতে বিএনপি-জামায়াতের অন্তত ১১ নেতা নিহত হয়েছেন। এছাড়া দেশব্যাপী বহু নেতাকর্মীকে অপহরণ ও গুম করা হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে বেড়ে গেছে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের ঘটনা। প্রায় প্রতিরাতেই রাজধানীসহ বিভিন্নস্থানে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতরা প্রায় সবাই আগে থেকেই পুলিশ হেফাজতে ছিল বলে তাদের পরিবার ও দলের অভিযোগ। এদের কাউকে রাস্তা থেকে আবার কাউকে জেলগেট থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে নিহতদের পরিবার।
সবশেষ সোমবার গভীর রাতে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে জোড়াপুকুর মাঠে ডিবি পুলিশের সাথে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনি।
দলের অভিযোগ, সোমবার বিকালে খিলগাঁও থানা বিএনপি নেতা দিপু সরকার, যুবদল নেতা মাইনুদ্দিন ও ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সাদা পোষাকধারীরা। এরপর মঙ্গলবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে জনির লাশ পাওয়া যায়। তবে অন্য দু’জনের হদিস মেলেনি এখনো।
নিহত জনির বাবা ইয়াকুব আলী জানান, ছোট ভাই মনিরুজ্জামানকে দেখতে সোমবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যায় জনি। সেখান থেকে সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা তাকে ধরে নিয়ে যায়।
এর আগে সোমবার রাত সাড়ে তিনটার দিকে নড়াইলের পৌর কাউন্সিলর ও জামায়াত নেতা ইমরুল কায়েস মতিঝিলের এজিবি কলোনী এলাকায় ডিবির সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। তার শরীরে অন্তত ১০টি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে।
গত ১৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। ইমরুলের স্ত্রী জানান, ঢাকায় বেড়াতে এসে গত ১৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার থেকে নিখোঁজ হন তিনি। সোমবার সকালের ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে ফোন করে জানানো হয় যে, তার স্বামী আর নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে তার লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়।
ইমরুলের স্ত্রী অভিযোগ করে বলেন, পুলিশ পরিকল্পিতভাবে তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করেছে।
এর আগে শুক্রবার রাতে যৌথবাহিনীর অভিযানের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে র্যাবের সথে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন আরেক ছাত্রদল নেতা মতিউর রহমান। নিহত মতিউর শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ছিলেন।
বিএনপির দাবি, গ্রেফতারের পর পরিকল্পিতভাবে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
এব্যাপারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপি সভাপতি অধ্যাপক মো. শাহজাহান মিঞা বলেন, মতিউর রহমানকে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করে। এরপর পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করে। তার বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা বা জিডিও ছিল না।
এর আগে গত ১৮ জানুয়ারি চুয়াডাঙ্গা সদরে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের উপর্যুপরি ছুড়িকাঘাত ও গুলিতে নিহত হয় শঙ্করচন্দ্রপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি মেম্বার ও ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি সিরাজুল ইসলাম (৪৭)।
গত ১৬ জানুয়ারি র্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের শ্যামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহ-সভাপতি মতিউর রহমান (২৩)। সে শিবগঞ্জ উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের আনসার আলীর ছেলে।
এ ব্যাপারে র্যাব জানায়, বিএনপি জোটের অবরোধে নাশকতার অভিযোগে আগের দিন বৃহস্পতিবার কানসাট বাজার থেকে মতিউরসহ ৩জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন তাদেরকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে যায় র্যাব-৫ এর সদস্যরা। এসময় সন্ত্রাসীরা র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে এ পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব পাল্টা গুলি চালালে মতিউর নিহত হয়।
১৫ জানুয়ারি নোয়াখালীতে যুবলীগ কর্মীদের গুলিতে নিহত হয় ছাত্রদল নেতা মোর্শেদ আলম পারভেজ। তিনি সোনাইমুরী ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
৭ জানুয়ারি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ছাত্রদল কর্মী মহসিন উদ্দিন (৩০) ও যুবদল কর্মী মিজানুর রহমান রুবেল (৩৭)।
জানা যায়, ঘটনার দিন সকালে চৌমুহনী বাজারে জামায়াত ও বিএনপি কর্মীরা মিছিল বের করতে চাইলে তাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে মহসিন ও রুবেল গুলিবিদ্ধ হয়। তাদেরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে ‘৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালন উপলক্ষে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের সঙ্গে ২০ দল নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এদিন দেশের পৃথক স্থানে সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়। এদের মধ্যে নাটোরের তেবাড়িয়ায় গণতন্ত্র হত্যা দিবসে কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করার সময় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পুলিশের পাহারায় মিছিলে গুলি চালালে ছাত্রদল নেতা রাকিব ও রায়হান রানা নিহত হন। রাজশাহীর বানেশ্বরে কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করার সময় পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা মিছিলে গুলি চালালে এতে বিএনপি কর্মী মজির উদ্দিন নিহত হন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বিএনপি কর্মী জমশেদ আলী নিহত হয়েছে। এছাড়া ওই দিন সারাদেশে সংঘর্ষে সহস্রাধিক আহত ও ১১ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।
মূলত, ৫ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ উপলক্ষে রাজধানীতে সমাবেশ করার অনুমতি চায় বিএনপি। কিন্তু ডিএমপির পক্ষ থেকে অনুমতি না মেলায় সে সমাবেশ করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে কর্মসূচির দুই দিন আগে ৩ জানুয়ারি রাতেই গুলশানে নিজ কার্যালয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করা হয়। পরে ৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়া কার্যালয় থেকে বের হতে চাইলে পুলিশ পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করে ও গেটে তালা লাগিয়ে দেয়।
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করে বলেন, নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এজন্যই দেশব্যাপী গুম-খুনে মেতে উঠেছে তারা। আর এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ-র্যাবকে।
এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাসা ও অফিসে হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সরকার সমর্থকরা এসব হামলায় নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে অভিযোগ বিএনপি নেতাদের। শুধু গুপ্ত হত্যাই নয়, গত কয়েকদিনে গুলশানে নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসা নেতাকর্মীদেরও উপরও হামলা চালানো হয়েছে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে ও গুলি বর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। এসময় বিশিষ্ট কূটনীতিক রিয়াজ রহমানের শরীরে চারটি গুলি লাগে।
কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আইন বহির্ভূতভাবে বিরোধী নেতাকর্মীদের হত্যার সমালোচনা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া জাস্ট নিউজকে জানান, এধরনের হত্যাকান্ড সংবিধান পরিপন্থী, আইন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা পুলিশের এ ধরনের কাজের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সরকারের এজেন্ডা বাস্তাবায়নের জন্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যাবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব এডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, বর্তমান সরকার তাদের অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যার নীল নকশায় মেতে উঠেছে।
তিনি বলেন, ২০ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচিতে জনসমর্থন দেখে দ্বিগবিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজেদের অস্তিত টিকিয়ে রাখতে ও ক্ষমতা সুরক্ষিত করতেই অবৈধ সরকার বিএনপি নেতাকর্মীদেরকে গুম ও তথাকথিত বন্দুক যুদ্ধের নামে পৈশাচিকভাবে হত্যা করছে। তবে এসব হত্যাকান্ড চালিয়ে অবৈধ সরকারের শেষ রক্ষা হবে না।