সাধারণত প্রতিবছর ১৪ বা ১৫ই জানুয়ারি পৌষের শেষ দিনে অর্থাৎ পৌষ সংক্রান্তিকে ঘিরে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে ঢাকাবাসি। বয়স ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পুরান ঢাকার ছেলে-বুড়ো সবাই শামিল হয় এই উৎসবে। দূর হয়ে যায় প্রজন্মের ব্যবধান; নাটাই হাতে পিতাপুত্র নেমে পড়ে ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতায়। মেতেওঠে ঘুড়িতে ঘুড়িতে প্যাঁচকষা আর কাটাকাটির খেলায়। সুতোয় মাঞ্জামেরে দিনভর চলে এই খেলা।
এরপর একসময় সূর্যিমামা বিদায় নিলে যখন বাংলার আকাশে নেমে আসে ঘণকালো অন্ধকার তখন শুরু হয় আতশবাজীর আলোর ঝলকানি আর বাড়ির ছাদে ছাদে চলে আনন্দ উৎসব। তরুনরা আতশবাজী পোড়ায় ও মুখে কেরোসিন তেল নিয়ে আগুন দিয়ে চমৎকার এক ধোঁয়ার কু-লী তৈরী করে আকাশে ছেড়ে দেয়।
ইতিহাসের পাতায় সাকরাইন উৎসব:
পৌষ মাসের শেষ দিন সাকরাইনে নতুন ধানের চালের পিঠাপুলি খেয়ে, ঘুড়ি উড়িয়ে আনন্দ উৎসব করার রেওয়াজ বহু পুরনো। ঢাকায় এই উৎসব হচ্ছে প্রায় ৪০০ বছর ধরে। বাংলাদেশের পুরানো ঢাকায় ঘুড়ি ওড়ানো বিনোদন শুরু হয়েছিল মুঘল আমলে। কথিত আছে, ১৭৪০ সালে নবাব নাজিম মহম্মদ খাঁ এই ঘুড়ি উৎসবের সূচনা করেন। সেই থেকে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এই ঘুড়ি উৎসব পশ্চিম ভারতের গুজরাটেও পালিত হয়। সেখানে মানুষ সুন্দর সুন্দর ঘুড়ির মাধ্যমে সূর্যদেবতার কাছে নিজেদের ইচ্ছা ও আকুতি প্রেরণ করেন। উত্তর ভারতীয় এ ঘুড়ি উৎসবটিকে স্থানীয়রা 'সাকরাইন' নামে অভিহিত করে।
অতীতে সাকরাইনে পুরান ঢাকায় শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইদের নাটাই, বাহারি ঘুড়ি উপহার দেওয়া এবং পিঠার ডালা পাঠানো ছিলো অবশ্য পালনীয় অনুসঙ্গ। ডালা হিসেবে আসা ঘুড়ি, পিঠা আর অন্যান্য খাবার বিলি করা হতো আতœীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের মাঝে। একটা নীরব প্রতিযোগিতা চলতো কার শ্বশুরবাড়ি হতে কত বড় ডালা এসেছে। আজ এই সব চমৎকার আচারগুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে। পুরান ঢাকার আদি বসবাসকারী সকল মানুষ আজও এই ঐতিহ্যগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করেন।
বাহারী যত ঘুড়ি :
সাকরাইন উৎসবের দিন সারাদিন আকাশে উড়ানো হয় নানান রঙের , নানান আকারের বিচিত্রদর্শন সব ঘুড়ি। দেখতে যেমন তাদের নামও তেমন বাহারি- গাহেল, চোখদার, চানদার, নাকপান্দার, ভোয়াদার, কাউঠাদার, চিলা, চাপরাস, মাখখি আরও কত কি!
এদিন আকাশে উড়ে চোখদ্বার, মালাদ্বার, পঙ্খীরাজ, চশমাদ্বার, কাউঠাদ্বার, চাপালিশ, চানদ্বার, এক রঙা ইত্যাদি ঘুড়ি। এমনকি জাতীয় পতাকার রঙেও তৈরি করা হয় ঘুড়ি । তবে ঘুড়ির চেয়েও সুন্দর হয় এর লেজ। লেজ অনেক আকৃতির ও রঙ বেরঙ এর হয়ে থাকে। ঘুড়ির সঙ্গে সঙ্গে নাটাইগুলোর নামও বেশ মজাদার। বাটিওয়ালা, মুখবান্ধা, মুখছাড়া ইত্যাদি।
সাকরাইনের উপায় উপকরণের খোজ খবর:
সাকরাইন উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ হলো ঘুড়ি। আর শাঁখারিবাজার হচ্ছে ঘুড়ি-নাটাই-সুতার সবচেয়ে বড় পাইকারি ও খুচরা বাজার। ঘুড়ির দাম শুরু হয় ২ টাকা থেকে । আছে ২৫০-৩০০ টাকার ঘুড়িও। নাটাইয়ের দাম নির্ভর করে তার আকার আকৃতি ও ফিনিশিং এর উপর। পাওয়া যাবে ৫০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকার ভিতর। নিনজা, ড্রাগন , হ্যামার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কাটাকাটি খেলার উপযোগী ধারালো মাঞ্জা সুতা পাওয়া যাবে ৬০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে।
বর্তমানে যেমন আছে সাকরাইন:
সময়ের সাথে সাথে সাকরাইন উৎসবেও এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। এক সময়ের চকলেট, শলতা আর পাটকার আধিপত্য ছাপিয়ে এখন আতশবাজির জয়জয়কার! মাইকের জায়গা দখল করে নিয়েছে ডিজে। সাকরাইন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী উৎসব হলেও এই উৎসবটি আর আগের মত জানান দিতে পারছেনা নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে তরুনদের মনে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ছোবলে বাংলার প্রাচীন অনেক উৎসবের মতোই সাকরাইও হারাতে বসেছে তার মাধুর্য্য। গুটিয়ে আসছে তার পরিধি।
তবে উৎসবের অনুষঙ্গে পরিবর্তন এলেও আমেজ আর আবেগটা এখনও রয়ে গেছে আগের মত। যান্ত্রিক এই নগরজীবনে তার আবেগ, তার আমেজ নিয়ে বেঁচে থাকুক সাকরাইন।
লেখক: আকতার হাবিব
জাস্ট নিউজবিডি ডটকম
সূত্র: উইকিপিডিয়া, ব্লগ