সেই ছোটবেলা থেকেই দেখতাম যে, বছরের নির্দিষ্ট একটি দিন এলেই সকালে মা আমাদের সকল ভাইবোন কে ডেকে কড়া ভাষায় বলে দিতেন। এই আজ কিন্তু সারা দিন কেউ কারো সাথে ঝগড়া করবি না, দুষ্টুমিও করবি না। মায়ের কথা শুনে বুঝতাম আজকে কোন বিশেষ দিন হবে হয়তো যার কারনে ম্পেশাল ভাবে আজকেই এই দিনটিতে কারো সাথে ঝগড়া করা যাবে না, ভালো ভাবে চলতে হবে। এবং সেই আলোকেই সারা দিন ভালো থাকার চেষ্টা করতাম।
গ্রাম গঞ্জে একধরনের কথা প্রচলিত আছে, যে বছরের প্রথম দিন যা করবে, সারা বছরও তাই করতে হয়। কিন্তু কালের পরিক্রমায় দিনের আবর্তে এখন বুঝতে পারছি যে মায়ের বলা স্পেশাল সেই দিনটি হচ্ছে আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতির শেকড়, চেতনার আধার পহেলা বৈশাখ। বাংলা বছরের প্রথম দিন। যা আমরা বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালন করি।
বছরের অন্যান্য দিনে যে ছেলেটি বা মেয়েটি ফাস্ট ফুডে মজে থাকে সেদিন তারা পান্তা খাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামে। ওয়েস্টার্ন পোষাকে আগ্রহী যুবকরা পাজামা পাঞ্জাবী পরে আর যুবারা লাল সাদা বাসন্তী রঙ্গের শাড়ী পরে খোপায় ফুল গেথে পরিবেশটাকে রাঙিয়ে তোলে। সবত্রই একটা সাঝ সাঝ রব, উৎসবের আমেজ।
বর্ষ বরণের এই রেওয়াজ শুধু আমাদের দেশে বা শুধু বাঙ্গালী জাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বর্ষবরণের রেওয়াজ পৃথিবীর প্রধান প্রধান সকল ভাষা ও জাতির মধ্যেই রয়েছে। বৈশাখ এলেই আমাদের মাঝে উৎসবের রোল পড়ে যায়। শুরু হয় ব্যপক আয়োজন।
নব বর্ষের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : অন্যান্য জাতির ন্যায় আমরাও বিপুল উৎসাহ উদ্দিপনার মাদ্যমে ১লা বৈশাখকে বরণ করে নেই। কিন্তু এই নব বর্ষের প্রকৃত ইতিহাস আমরা অনেকেই জানি না।
মুঘল আমলে এই উপমহাদেশ ছিল সম্পূর্ণ কৃষি নির্ভর। তৎকালীন শাষকরা কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের একটা রেওয়াজ ছিল। সেই সময় কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হতো হিজরী সনের অনুযায়ী। কিন্তু এতে সমস্যা হলো হিজরী সনের প্রথম দিন একেক বছর একেক সময় আসে। যা আমাদের দেশের কৃষি প্রকৃতির সাথে তেমন সামঞ্জস্য ছিল না। ফলে অনেক সময় কৃষকের ফসল হীন অবস্থায়ও খাজনা দিতে হতো। ১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবর ক্ষমতা গ্রহনের পর দেখলেন, অকৃষি মৌসুমে কৃষকদের খাজনা দিতে খুবই কষ্ট হতো। তাছাড়া সম্রাটের পক্ষেও খাজনা আদায় সম্ভব হত না। সব মিলিয়ে প্রশাসনিক কাজে সমস্য দেখা দিত। তাই এ সমস্যা সমাধানে সম্রাট আকবর সে সময়ের বিশিষ্ট পন্ডিত ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে বাংলার ঋতুর সাথে তথা ফসল তোলার মৌসুমের সাথে মিল রেখে একটা নতুন দিনপঞ্জি তৈরীর নির্দেশ দেন। পরে ফতেহউল্লাহ সিরাজী ইংরেজী ও হিজরী সনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এবং কৃষকদের অনুকুলে বাংলার প্রকৃতির সাথে মিল রেখে একটি নতুন দিন পঞ্জি তৈরী করলেন।
ফতেহউল্লাহ সিরাজী দিন পঞ্জি তৈরী করেন ১৫৮৪ সালের ১০ কি ১১ মার্চ কিন্তু বাংলা সন গণনা শুরু করেন ১৫৫৬ সাল থেকে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহনের সময় থেকে। আর যেহেতু বাংলা দিনপঞ্জি তৈরী করা হয়েছে হিজরী এবং ইংরেজী সনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সেহেতু বাংলা সন এবং ইংরেজী সন খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। আরেকটি তথ্য হলো বাংলা সন সব সময় ইংরেজী সন থেকে ৫৯৩ বছর পিছিয়ে থাকবে। সে অনুযায়ী কেউ যদি বর্তমানে বাংলা সন কত তা জানতে চায় তাহলে বর্তমানের ইংরেজী সন থেকে ৫৯৩ বিয়োগ করলেই বাংলা সন পেয়ে যাবেন।
আরেকটি মজার তথ্য হলো আমাদের বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ সব সময় ১৪ই এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ভারতে এমনটি হয় না। সেখানে কখনো ১৪ এপ্রিল আবার কখনো ১৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। এর কারণ হলো ইংরেজী সনে লিপ ইয়ারের কারনে কখনো একদিন বেড়ে যায়। আর আগে বাংলা সনে কোন লিপ ইয়ার ছিল না। ফলে বাংলা দিনপঞ্জিতে একদিন হেরফের হয়। এই সমস্যা সমাধানের লক্ষে আমাদের দেশে ১৯৬৬সালের ১৭ ই ফেব্রুয়ারি ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি বাংলা সনকে সংশোধন করেন।
পরবর্তীতে ১৯৮৭ সন থেকে বাংলাদেশে নতুন দিনপঞ্জি অনুযায়ী দিন গননা করা হয়। আরো একটি তথ্য হলো আমরা বাংলা নব বর্ষের প্রকৃত ইতিহাস হিসেবে আকবরীয় ধারনাকেই মানি। ভারতে কিন্তু তা মানা হয় না। বরং তারা রাজা শশাঙ্কের সময়ের ইতিহাসকে বাংলা ক্যালেন্ডারের ইতিহাস হিসেবে মনে করে। যার শাষন কাল ছিল ৫৯০ থেকে ৬২৫ খৃষ্টাব্দের মাঝামাঝি।
নব বর্ষের যত আয়োজন: আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে বাংলা বর্ষ বরণ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ একটি বৃহত ও জাতীয় উৎসব। ছোট বড়, ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলিম, শহর গ্রাম নির্বিশেষে সকল গোত্র বর্ণের বাঙ্গালীর প্রানের উৎসব পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে প্রাচীন অনুষ্ঠান “হাল খাতা”। যুগ যুগ ধরে আমাদের সংস্কৃতিতে যে পদ্ধতিটি চলে আসছে তা হলো হাল খাতা। হাল খাতা পহেলা বৈশাখেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এদিন গ্রামে গঞ্জে শহরের প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যবসায়ীরা তাদের পুরোনো বছরের সকল হিসাব নিকাশ শেষ করে বকেয়া টাকা আদায় করে। নতুন বছরের নতুন খাতা উদ্বোধন করা হয়। তাই ব্যবসায়ীদের কাছে দিনটির তাৎপর্য অনেক। এ উপলক্ষে প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আয়োজন করা হয় মিলাদ মাহফিল, মিষ্টি বিতরন করা হয়।
সব মিলিয়ে একটি উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এছাড়াও গ্রামে গঞ্জে শহরে বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আয়োজন করা করা বৈশাখী মেলার। বৈশাখী মেলা এ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির শেকড়। মেলা গুলোতে মুড়ি মুরকি আর বাহারী খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে বিক্রেতারা। সেই সাথে নানা ধরণের গ্রাম্য মিস্টান্ন, পোড়া মাটি দিয়ে তৈরী বাচ্চাদের বিভিন্ন খেলা সামগ্রী, মেয়েদের সাঁঝগোজের বিভিন্ন আইটেম পাওয়া যায় মেলা গুলোতে। এছাড়াও বিনোদনের জন্য নাড়র দোলা, চড়কা ঘোরা, পুতুল নাচসহ বিভিন্ন আকর্ষনীয় গ্রাম্য খেলার আয়োজনতো থাকেই। তবে বর্তমানে গ্রামে গঞ্জে এধরণের মেলা অনেকটা খেই হারিয়ে ফেলছে। বৈশাখী মেলার নামে মাঝে মাঝে অশ্লীল নৃত্য আর জুয়ার আসরের খবরও পাওয়া যায় মাঝে মাঝে।
তবে শহরজীবনে একটু আলাদা আঙিকে বৈশাখী মেলার কদর বাড়ছে দিন দিন। পহেলা বৈশাখে শহরে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় আনন্দ উৎসবের নতুন মাত্রা যোগ করে। রং বেরং এর পোষাক পরে ছেলে মেয়েরা রাস্তায় নেমে আসে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান গুলোতে সেদিন উপচেপড়া ভীড় লক্ষ করা যায়। ঢাকায় পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় আয়োজনটি হয় রমনাতে। রমনা পার্কের বটমূলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংঘটন অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে বের হয় মঙ্গল সোভাযাত্রা। এতে অংশ নেয় বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সকল শ্রেনী পেশার নারী পুরুষ।
এছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন এলাকায় বা পার্কে বিশেষ কনসার্ট, অনুষ্ঠান, সেমিনার র্যালীর আয়োজন করে। পত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড় পত্র প্রকাশ করে। টিভি ও রেডিও চ্যানেলগুলো পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্রকরে বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান নির্মান ও প্রচার করে থাকে।
ভোজের আয়োজন: পহেলা বৈশাখের ভোজন পর্ব একটি অপরিহার্য আয়োজন। ভোজন বিলাসী বাঙ্গালীর সারা বছর পছন্দের তালিকায় চাইনিজ আর ফাষ্ট ফুড থাকলেও এই দিনটি একেবারেই আলাদা। এই দিনে পান্তা, ইলিশ আর কাচা মরিচ, পেয়াজের কদর বেড়ে যায় বহুগুন। পান্তা ইলিশ ছাড়া যেন পহেলা বৈশাখ পালনই হয়না । এমনকি রাজধানীর বিভিন্ন চাইনিজ রেস্টুরেন্ট গুলোতেও পান্তা ইলিশের বিশেষ প্যাকেজ ও ছাড় চোখে পড়ার মতো।
পহেলা বৈশাখ আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। পহেলা এলেই আমরা একদিনের জন্য বাঙ্গালী সাজার চেষ্টা করি। অথচ সরা বছর ভীনদেশী সংস্কৃতি আর অনুষ্ঠান নিয়ে মত্ত থাকি। নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, আর সংস্কৃতিকে ভুলে থাকি। তাই এই পহেলা বৈশাখে আমাদের শপথ হোক শুধু মাত্র একদিনের বাঙ্গালী সাঁজার চেষ্টা না করে বরং আমরা সারা বছরই বাঙ্গালী থাকবো। বাংলা সংস্কৃতির চর্চা করবো।
নব বর্ষের মানুষের চিরন্তন অভিলাষ সামনের বছরটি যেন ভাল কাটে। আমাদের ও প্রত্যাশা আগামীদিন গুলো আমাদের সকলের জন্য বয়ে আনুক অনাবিল সুখ,সমৃদ্ধি আর শান্তি। আগামী বছরটি সকলের ভাল কাটুক এই কামনায় শেষ করছি । সবাইকে শুভ নববর্ষ।