ছবির মতোই সুন্দর ছিল আমার গ্রামটা...

বর্ষা মৌসুমে নৌকা ছাড়া চলাচলের কোন উপায় থাকতোনা। যেন মহসড়কের পাশে বিচ্ছিন্ন ছোটএকটা দ্বীপ।

সমস্যা যত বড়ই হোক, আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে

আমরা অবশ্যই পারব৷ সমস্যা যত বড়ই হোক না কেন, আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে অনুপ্রেরণা জোগায়৷ কিন্তু সমস্যাকে নিজের চোখে না দেখলে শুধু আশা দিয়ে সমস্যা সমাধান করা যায় না৷

ঘুরে আসুন নারায়ণগঞ্জের সব দর্শনীয় স্থানে

অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি জেলায়ই রয়েছে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। যা আমাদের দেশকে করেছে আরো সমৃদ্ধ। শত বছর ধরে লাখো পর্যটককে করেছে আকৃষ্ট।

মানবসেবাই সর্বোত্তম ধর্ম: ফাদার তেরেসা

অসহায়, দুস্থ মানুষের সহায়তাই তার ধ্যান-জ্ঞান।সহিংসতার বিপরীতে তিনি অসহায়ের ত্রানকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন।তিনি পাকিস্তানের আবদুল সাত্তার ইদি।অসম্ভব মানবসেবার কারনে ৮৪ বছর বয়সী এই ব্যক্তি তার দেশে ফাদার তেরেসা নামেই বেশি পরিচিত।

‘মানসিক প্রশান্তির জন্য সাইকেল’

যাত্রা পথে পরিবহন নিয়ে দুশ্চিন্তা আর ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে বিকল্প হলো একটা বাই সাইকেল। তাছাড়া ইদানিং স্বাস্থ্যটার দিকেও মনে হচ্ছে একটু যত্ন নেয়া দরকার।

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৪

বাঙ্গালী সংস্কৃতির শেকড় পহেলা বৈশাখ, আমাদের প্রাণের উৎসব

আকতার হোসেন:
সেই ছোটবেলা থেকেই দেখতাম যে, বছরের নির্দিষ্ট একটি দিন এলেই সকালে মা আমাদের সকল ভাইবোন কে  ডেকে কড়া ভাষায় বলে দিতেন। এই আজ কিন্তু সারা দিন কেউ কারো সাথে ঝগড়া করবি না, দুষ্টুমিও করবি না। মায়ের কথা শুনে বুঝতাম আজকে কোন বিশেষ দিন হবে হয়তো যার কারনে ম্পেশাল ভাবে আজকেই এই দিনটিতে কারো সাথে ঝগড়া করা যাবে না, ভালো ভাবে চলতে হবে। এবং সেই আলোকেই সারা দিন ভালো থাকার চেষ্টা করতাম।

গ্রাম গঞ্জে একধরনের কথা প্রচলিত আছে, যে বছরের প্রথম দিন যা করবে, সারা বছরও তাই করতে হয়।  কিন্তু কালের পরিক্রমায় দিনের আবর্তে এখন বুঝতে পারছি যে মায়ের বলা স্পেশাল সেই দিনটি হচ্ছে আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতির শেকড়, চেতনার আধার পহেলা বৈশাখ। বাংলা বছরের প্রথম দিন। যা আমরা বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালন করি।
শহুরে জীবনে প্রবেশের পর আরেকটি সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হলাম তা হলো বছরের একটি নির্দিষ্ট দিন এলেই পান্তা ইলিশ খাওয়ার একটা ধুম পড়ে যায়।

বছরের অন্যান্য দিনে যে ছেলেটি বা মেয়েটি ফাস্ট ফুডে মজে থাকে সেদিন তারা পান্তা খাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামে। ওয়েস্টার্ন পোষাকে আগ্রহী যুবকরা পাজামা পাঞ্জাবী পরে আর যুবারা লাল সাদা বাসন্তী রঙ্গের শাড়ী পরে খোপায় ফুল গেথে পরিবেশটাকে রাঙিয়ে তোলে। সবত্রই একটা সাঝ সাঝ রব, উৎসবের আমেজ।

যাই হোক উৎসবের ধরণটা যেমনই হোক গ্রীষ্মের তীব্র খড়তাপের এই দিনটিতে পুরনো একটি বছরকে ইতিহাসের ঝুড়িতে ফেলে আরেকটি নতুন বছরের আগমন ঘটে আমাদের মাঝে। আমরাও অতীতের সব দু:খ বেদনা, ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে গিয়ে নতুন আগামীর স্বপ্নে বিভোর হয়ে বরণ করে নেই নতুন বছরটিকে। আশায় থাকি সামনের দিনগুলি যেন হয় অনাবিল সুখ সমৃদ্ধি আর আন্দন্দের। সেই সাথে শপথ নেই সকল প্রকার হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেস ভুলে গিয়ে নতুন ভাবে নব উদ্যোমে সামনে চলার।

বর্ষ বরণের এই রেওয়াজ শুধু আমাদের দেশে বা শুধু বাঙ্গালী জাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বর্ষবরণের রেওয়াজ পৃথিবীর প্রধান প্রধান সকল ভাষা ও জাতির মধ্যেই রয়েছে। বৈশাখ এলেই আমাদের মাঝে উৎসবের রোল পড়ে যায়। শুরু হয় ব্যপক আয়োজন।

নব বর্ষের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : অন্যান্য জাতির ন্যায় আমরাও বিপুল উৎসাহ উদ্দিপনার মাদ্যমে  ১লা বৈশাখকে বরণ করে নেই। কিন্তু এই নব বর্ষের প্রকৃত ইতিহাস আমরা অনেকেই জানি না।
মুঘল আমলে এই উপমহাদেশ  ছিল সম্পূর্ণ কৃষি নির্ভর। তৎকালীন শাষকরা কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের একটা রেওয়াজ ছিল। সেই সময় কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হতো হিজরী সনের অনুযায়ী। কিন্তু  এতে সমস্যা হলো হিজরী সনের প্রথম দিন একেক বছর একেক সময় আসে। যা আমাদের দেশের কৃষি প্রকৃতির সাথে তেমন সামঞ্জস্য ছিল না। ফলে অনেক সময় কৃষকের ফসল হীন অবস্থায়ও খাজনা দিতে হতো। ১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবর ক্ষমতা গ্রহনের পর দেখলেন, অকৃষি মৌসুমে কৃষকদের খাজনা দিতে খুবই কষ্ট হতো। তাছাড়া সম্রাটের পক্ষেও খাজনা আদায় সম্ভব হত না। সব মিলিয়ে প্রশাসনিক কাজে সমস্য দেখা দিত।  তাই এ সমস্যা সমাধানে সম্রাট আকবর সে সময়ের বিশিষ্ট পন্ডিত ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে বাংলার ঋতুর সাথে তথা ফসল তোলার মৌসুমের সাথে মিল রেখে একটা নতুন দিনপঞ্জি তৈরীর  নির্দেশ দেন। পরে ফতেহউল্লাহ সিরাজী ইংরেজী ও হিজরী সনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এবং কৃষকদের অনুকুলে বাংলার প্রকৃতির সাথে মিল রেখে একটি নতুন দিন পঞ্জি তৈরী করলেন। 
আর বিশাখা নামক নক্ষত্রের নামের সাথে মিল রেখে প্রথম মাসের নাম দিলেন বৈশাখ। তবে এখানে একটা লক্ষনীয় ব্যাপার হলো যে দিন থেকে এই দিন পঞ্জি প্রবর্তন হলো সে দিন থেকে কিন্তু বাংলা বর্ষের দিন গননা শুরু হয়নি। হয়েছে তারও আগে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে।

ফতেহউল্লাহ সিরাজী দিন পঞ্জি তৈরী করেন ১৫৮৪ সালের ১০ কি ১১ মার্চ কিন্তু বাংলা সন গণনা শুরু করেন ১৫৫৬ সাল থেকে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহনের সময় থেকে। আর যেহেতু বাংলা দিনপঞ্জি তৈরী করা হয়েছে হিজরী এবং ইংরেজী  সনের সাথে সামঞ্জস্য  রেখে সেহেতু বাংলা সন এবং ইংরেজী সন খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। আরেকটি তথ্য হলো বাংলা সন সব সময় ইংরেজী সন থেকে ৫৯৩ বছর পিছিয়ে থাকবে। সে অনুযায়ী কেউ যদি বর্তমানে বাংলা সন কত তা জানতে চায় তাহলে বর্তমানের ইংরেজী সন থেকে  ৫৯৩ বিয়োগ করলেই বাংলা সন পেয়ে যাবেন।

আরেকটি মজার তথ্য হলো আমাদের বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ সব সময়  ১৪ই এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ভারতে এমনটি হয় না। সেখানে কখনো ১৪ এপ্রিল আবার কখনো ১৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। এর কারণ হলো ইংরেজী সনে লিপ ইয়ারের কারনে কখনো একদিন বেড়ে যায়। আর আগে বাংলা সনে কোন লিপ ইয়ার ছিল না। ফলে বাংলা দিনপঞ্জিতে একদিন হেরফের হয়। এই সমস্যা সমাধানের লক্ষে আমাদের দেশে ১৯৬৬সালের ১৭ ই ফেব্রুয়ারি ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি বাংলা সনকে সংশোধন করেন।

পরবর্তীতে ১৯৮৭ সন থেকে বাংলাদেশে নতুন দিনপঞ্জি  অনুযায়ী  দিন গননা করা হয়। আরো একটি তথ্য হলো আমরা বাংলা নব বর্ষের প্রকৃত ইতিহাস হিসেবে আকবরীয় ধারনাকেই  মানি। ভারতে কিন্তু তা মানা হয় না। বরং তারা রাজা শশাঙ্কের সময়ের ইতিহাসকে বাংলা ক্যালেন্ডারের ইতিহাস হিসেবে মনে করে। যার শাষন কাল ছিল ৫৯০ থেকে ৬২৫ খৃষ্টাব্দের মাঝামাঝি।
নব বর্ষের যত আয়োজন:  আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে বাংলা বর্ষ বরণ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ একটি বৃহত ও জাতীয় উৎসব। ছোট বড়, ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলিম, শহর গ্রাম নির্বিশেষে সকল গোত্র বর্ণের বাঙ্গালীর প্রানের উৎসব পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে প্রাচীন অনুষ্ঠান “হাল খাতা”। যুগ যুগ ধরে আমাদের সংস্কৃতিতে যে পদ্ধতিটি চলে আসছে তা হলো হাল খাতা। হাল খাতা পহেলা বৈশাখেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এদিন গ্রামে গঞ্জে শহরের প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যবসায়ীরা তাদের পুরোনো বছরের সকল হিসাব নিকাশ শেষ করে বকেয়া টাকা আদায় করে। নতুন বছরের নতুন খাতা উদ্বোধন করা হয়। তাই ব্যবসায়ীদের কাছে দিনটির তাৎপর্য অনেক। এ উপলক্ষে প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আয়োজন করা হয় মিলাদ মাহফিল, মিষ্টি বিতরন করা হয়।

সব মিলিয়ে একটি উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এছাড়াও গ্রামে গঞ্জে শহরে বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আয়োজন করা করা বৈশাখী মেলার। বৈশাখী মেলা এ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির শেকড়। মেলা গুলোতে মুড়ি মুরকি আর বাহারী খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে বিক্রেতারা। সেই সাথে নানা ধরণের গ্রাম্য মিস্টান্ন, পোড়া মাটি দিয়ে তৈরী বাচ্চাদের বিভিন্ন খেলা সামগ্রী, মেয়েদের সাঁঝগোজের বিভিন্ন আইটেম পাওয়া যায় মেলা গুলোতে। এছাড়াও বিনোদনের জন্য নাড়র দোলা, চড়কা ঘোরা, পুতুল নাচসহ বিভিন্ন আকর্ষনীয় গ্রাম্য খেলার আয়োজনতো থাকেই। তবে বর্তমানে গ্রামে গঞ্জে এধরণের মেলা অনেকটা খেই হারিয়ে ফেলছে। বৈশাখী মেলার নামে মাঝে মাঝে অশ্লীল নৃত্য আর জুয়ার আসরের খবরও পাওয়া যায় মাঝে মাঝে।

তবে শহরজীবনে একটু আলাদা আঙিকে বৈশাখী মেলার কদর বাড়ছে দিন দিন। পহেলা বৈশাখে শহরে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় আনন্দ উৎসবের নতুন মাত্রা যোগ করে। রং বেরং এর পোষাক পরে ছেলে মেয়েরা রাস্তায় নেমে আসে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান গুলোতে সেদিন উপচেপড়া ভীড় লক্ষ করা যায়। ঢাকায় পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় আয়োজনটি হয় রমনাতে। রমনা পার্কের বটমূলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংঘটন অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে বের হয় মঙ্গল সোভাযাত্রা। এতে অংশ নেয় বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সকল শ্রেনী পেশার নারী পুরুষ।

এছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন এলাকায় বা পার্কে বিশেষ কনসার্ট, অনুষ্ঠান, সেমিনার র‌্যালীর আয়োজন করে। পত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড় পত্র প্রকাশ করে। টিভি ও রেডিও চ্যানেলগুলো পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্রকরে বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান নির্মান ও প্রচার করে থাকে।

ভোজের আয়োজন: পহেলা বৈশাখের ভোজন পর্ব একটি অপরিহার্য  আয়োজন। ভোজন বিলাসী বাঙ্গালীর সারা বছর পছন্দের তালিকায় চাইনিজ আর ফাষ্ট ফুড থাকলেও এই দিনটি একেবারেই আলাদা। এই দিনে পান্তা, ইলিশ আর কাচা মরিচ, পেয়াজের কদর বেড়ে যায় বহুগুন। পান্তা ইলিশ ছাড়া যেন পহেলা বৈশাখ পালনই হয়না । এমনকি রাজধানীর বিভিন্ন চাইনিজ রেস্টুরেন্ট গুলোতেও পান্তা ইলিশের বিশেষ প্যাকেজ ও ছাড় চোখে পড়ার মতো।

পহেলা বৈশাখ আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। পহেলা এলেই আমরা একদিনের জন্য বাঙ্গালী সাজার চেষ্টা করি। অথচ সরা বছর ভীনদেশী সংস্কৃতি আর অনুষ্ঠান নিয়ে মত্ত থাকি। নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, আর সংস্কৃতিকে  ভুলে থাকি। তাই এই পহেলা বৈশাখে আমাদের শপথ হোক শুধু মাত্র একদিনের বাঙ্গালী সাঁজার চেষ্টা না করে বরং আমরা সারা বছরই বাঙ্গালী থাকবো। বাংলা সংস্কৃতির চর্চা করবো।

নব বর্ষের মানুষের চিরন্তন অভিলাষ সামনের বছরটি যেন ভাল কাটে। আমাদের ও প্রত্যাশা আগামীদিন গুলো আমাদের সকলের জন্য বয়ে আনুক অনাবিল সুখ,সমৃদ্ধি আর শান্তি। আগামী বছরটি সকলের ভাল কাটুক এই কামনায় শেষ করছি । সবাইকে শুভ নববর্ষ।

রবিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৪

অটিজম কী? বাংলাদেশে এর প্রাদুর্ভাব। প্রতিকার কোনপথে

আকতার হোসেন:
ঢাকা, ২ এপ্রিল : বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির কল্যাণে অটিজম শব্দটির সঙ্গে আমরা মোটামুটি কমবেশি সবাই পরিচিত। প্রতিবছর ২ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়।

তবে অটিজম সম্পর্কে ধারণা রাখেন এমন ৮০ ভাগ লোকেরই অটিজম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান নেই। অনেকেই প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে বিষয়টিকে গুলিয়ে ফেলেন।

অটিজম বিষয়টি আসলে কী? কেনই বা এই রোগের প্রাদুর্ভাব। এর প্রভাব এবং প্রতিকার কোন পথে? চলুন আজকে এ সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়া যাক।

অটিজম শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ আউটোস থেকে। অর্থাৎ আত্ম বা নিজ। বিশেষ ধরনের স্নায়ুবিক (ডিসঅর্ডার অব নিউরাল ডেভেলপমেন্ট) সমস্যাই হলো অটিজম। অটিস্টরা আমাদের চারপাশের জগত থেকে নিজেদের কিছুটা আড়াল করে রাখে। তাদের নিজস্ব একটা মনোজগতে বসবাস করে। ফলে অনেক সময় এদের আচরণও হয় অস্বাভাবিক। সহজ করে বলতে গেলে এই ধরণের রোগীকে আমরা সাধারণত হাবাগোবা বলেই চালিয়ে দেই। তবে এ ক্ষেত্রে তাদেরকে মানসিক রোগী বলা যাবেনা। আচরণগত সমস্যা হিসেবে মানিয়ে নিতে হবে।


এ ব্যাপারে অকুপেশনাল থেরাপিস্ট ডা. উম্মে সায়কা নীলা বলেন, ‘অটিজম একটি মানসিক বিকাশগত সমস্যা যা সাধারণত জন্মের পর প্রথম তিন বছরের মধ্যে হয়ে থাকে। এই সমস্যার জন্য সামাজিক বিকাশ ও সামাজিক যোগাযোগ যেমন কথা বলা, ভাব বিনিময় করার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। তীব্র আলো, শব্দ, গন্ধ এসব সহ্য করতে পারে না অটিস্টরা। মানুষের সঙ্গে, এমনকি আপন জনের সঙ্গেও ভাববিনিময় করতে পারে না।’

১৯১১ সালে সর্বপ্রথম সুইস মনোবিজ্ঞানী অয়গেন ব্লয়লার অটিজমকে এক ধরনের মনোরোগ হিসেবে চিহ্নিত করেন। কয়েক দশক পরে রোগটি নিয়ে গবেষণা আরো বিস্তৃত হয়।

অটিজমের কারণ:
অটিজম মস্তিস্কের অস্বাভাবিক বায়োলজি ও কেমিস্ট্রির ফলে সৃষ্ট একটি সমস্যা। তবে ঠিক কী কারণে অটিজম হয় এ ব্যাপারে এখনো কোনো সুস্পষ্ট কারণ জানা যায়নি। সারা পৃথিবীতেই এই সমস্যার কারণ জানতে গবেষণা চলছে।

বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করে থাকেন জিনগত ত্রুটির কারণে অটিজম হতে পারে। যেমন কোনো পরিবারে যদি অটিজমের ইতিহাস থাকে তাহলে সেই পরিবারের শিশুটির অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা বেশি।

এছাড়া অটিজমের জন্য আরো কিছু বিষয়কে সন্দেহ করা হয়, এগুলো হচ্ছে গর্ভাবস্থায় খাদ্যাভ্যাস, বাচ্চার অন্ত্রের পরিবর্তনগত সমস্যা, মার্কারির (পারদ) বিষক্রিয়া, বাচ্চার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ পরিপাক করতে না পারা, টীকার প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।

অটিজম কত প্রকার:
অটিজমের কয়েকটি ধরন রয়েছে। এর মধ্যে ক্লাসিক অটিস্টিক ডিসঅর্ডার। যাকে ‘আর্লি ইনফ্যানটাইল অটিজম`-ও বলা হয়। সাধারণত তিন বছর বয়স হওয়ার আগেই এর লক্ষণ দেখা যায়। এতে শিশুর বিকাশে এক সাথে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। যেমন কথা বলার সমস্যা, যোগাযোগ ও বোঝার অসুবিধা ইত্যাদি।

আরেক প্রকারের অটিজম হলো অ্যাসপারজার্স সিনড্রোম। এ ক্ষেত্রে রোগীর স্বাভাবিক কথা বলার ক্ষমতা থাকলেও কারো সঙ্গে মিশতে পছন্দ করে না। বিশেষ কোনো একটি বিষয়ে পারদর্শী হয়, কিন্তু অন্য আরেকটি বিষয়ে কিছুই বুঝতে পারে না।

তবে অটিজম আক্রান্তদের মধ্যে কিছু বিষয়ে বেশ মিল দেখা যায়। তা হলো, তারা সবাই একই ধরনের আচরণ বার বার করে এবং সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না। হঠাৎ রেগে যায়।
কিভাবে বুঝবেন :
প্রাথমিক অবস্থায় ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে-
১। একটি শিশু যদি ১ বছরের মধ্যে মুখে অনেক আওয়াজ না করে, কিংবা আঙ্গুল দিয়ে বা অঙ্গভঙ্গি করে কোনো কিছু না দেখায়।
২। ১৬ মাসের ভেতর যদি এক শব্দের সংমিশ্রণে বাক্য না বলে।
৩। ২ বছরের ভেতর যদি দুই শব্দের সংমিশ্রণে বাক্য না বলে।
৪। একটি শিশুর কথা ও সামাজিক আচরণ যদি হঠাৎ হারিয়ে যায়।
৫। শিশু যদি চোখে চোখ না রাখে।

একটু বয়সীদের ক্ষেত্রে
১। নাম ধরে ডাকলে যদি সাড়া না দেয়।
২। অমিশুক হয় এবং আদর করা পছন্দ করে না।
৩। হঠাৎ করে খেপে ওঠে।
৪। সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না।
৫। কোনো ধরনের আনন্দদায়ক বস্তু বা বিষয় সে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেয় না।
৬। যদি একই শব্দ বা বাক্য বার বার উচ্চারণ করে বা তাকে বলা কোনো কথার পুনরাবৃত্তি করে।
৭। একই আচরণ বার বার করতে থাকে।
৮। আওয়াজ পছন্দ করে না।
৯। খুব বেশি রুটিন মেনে চলতে পছন্দ করে, আশপাশের কোনো পরিবর্তন সহ্য করতে পারে না।

এসব লক্ষণ সাধারণত তিন বছর বয়সের মধ্যে দেখা যায়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে আরেকটু পরেও দেখা দিতে পারে।


অটিজম রোগটির প্রাদুর্ভাব:
বাংলাদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ও বিস্তার সম্পর্কে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশে প্রতি ৫০০ জনে একজনকে অটিস্টিক শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে হিসেবে বাংলাদেশে ২.৫ লাখ শিশু অটিস্টিক। ইন্ডিয়াতেও ৫০০ জনে একজন, আমেরিকায় প্রতি ১০,০০০ জন শিশুর মধ্যে ৪.৫ জন শিশু অটিস্টিক।

বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে অটিজম নিয়ে তেমন কোনো সমীক্ষা হয়নি। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, শুধুমাত্র ঢাকা বিভাগেই অটিস্টিক শিশুর হার শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ (০.৮৪%)।

অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে ১৯৯০-২০০০ সালের মধ্যে। আর এ ক্ষেত্রে ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় বেশি ঝুঁকি সম্পন্ন বলে মন্তব্য করেছে বিজ্ঞানীরা। এর অনুপাত ৪:৩:১। বয়স্ক পিতা অটিজম হওয়ার জন্য বেশি দায়ী বয়স্ক মায়ের তুলনায়। কারণ বেশি বয়স্ক স্পার্ম দিয়ে মিউটেশন কঠিন হয়। অটিজম সাধারণত সকল জাতি, বর্ণ, গোত্র ও দেশে দেখা যায়।

চিকিৎসা:
বাচ্চা অটিস্টিক কিনা তা যাচাই এর জন্য কোনো প্যাথলজিক্যাল টেস্ট নেই। তবে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বাচ্চার আচরণ, পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদি বিবেচনা করে বাচ্চা অটিস্টিক কিনা তা বলতে পারেন। অটিজম এমন একটি কন্ডিশন যা কখনো পুরোপুরি ভালো হবার নয়। এটাকে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হয়। দ্রুত নির্ণয় করা গেলে অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসায় ভাল ফল পাওয়া যায়। অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রধান রওনক হাফিজের মতে, অটিজম বিষয়ে যতদ্রুত চিকিৎসা নেওয়া যাবে তত দ্রুতই ভাল ফল পাওয়া যাবে।

এই চিকিৎসা হচ্ছে একটি সমন্বিত চিকিৎসা যা পেডিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞ, নিউরো রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট এবং ক্ষেত্র বিশেষে ফিজিওথেরাপিস্ট এর সহযোগিতা নিতে হয়। আর প্রতিটি অটিস্টিক শিশুর জন্য আলাদা আলাদাভাবে চিকিৎসা পদ্ধতি নিরূপন করা হয়।


অটিজম প্রতিরোধে কিছু উদ্যোগ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বাংলাদেশ জাতীয় অটিজম উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান। তার উদ্যোগে সরকারি পর্যায়ে অটিজম নিয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেমন সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে মিরপুরে চালু হয়েছে ‘অটিজম রিসোর্স সেন্টার`। আর অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, অটিস্টিক শিশুদের অবস্থা পরিমাপসহ আরো অন্যান্য প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠন করা হয়েছে ‘সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিলড্রেন`।

শিশুর অটিজম বিষয়ে পরামর্শ পাবেন যেখানে

বর্তমানে বাংলাদেশে অটিজম নিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছে। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে বেশ কিছু সংস্থা। ‘অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন’ এদের মধ্যে অন্যতম।


ঢাকার শিশু হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের শিশুবিকাশ কেন্দ্রে অটিজম বিষয়ের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকায় ডা. রওনক হাফিজ, ডা. লিডি হক ও ডা. মল্লিক এবং চট্টগ্রামে ডা. বাসনা মুহুরী অটিজম নিয়ে কাজ করছেন।

ঢাকায় অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, এসডব্লিউএসি (সোয়াক), কেয়ারিং গ্লোরি, বিউটিফুল মাইন্ডসহ এ রকম বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করছে।

এ ব্যাপারে ঢাকার সরকারি শিশু হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্রের চিকিৎসক শিশু মনোবিজ্ঞানী ডা. সালমাআকরাম জানান, অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘অটিস্টিক শিশুরা কখনো দেশের বোঝা নয়। পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলে অনেক ক্ষেত্রে তারা ভাল করতে পারে। অটিস্টিক শিশুরা দেশের সম্পদে পরিণত হতে পারে।’