রবিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৪

অটিজম কী? বাংলাদেশে এর প্রাদুর্ভাব। প্রতিকার কোনপথে

আকতার হোসেন:
ঢাকা, ২ এপ্রিল : বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির কল্যাণে অটিজম শব্দটির সঙ্গে আমরা মোটামুটি কমবেশি সবাই পরিচিত। প্রতিবছর ২ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়।

তবে অটিজম সম্পর্কে ধারণা রাখেন এমন ৮০ ভাগ লোকেরই অটিজম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান নেই। অনেকেই প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে বিষয়টিকে গুলিয়ে ফেলেন।

অটিজম বিষয়টি আসলে কী? কেনই বা এই রোগের প্রাদুর্ভাব। এর প্রভাব এবং প্রতিকার কোন পথে? চলুন আজকে এ সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়া যাক।

অটিজম শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ আউটোস থেকে। অর্থাৎ আত্ম বা নিজ। বিশেষ ধরনের স্নায়ুবিক (ডিসঅর্ডার অব নিউরাল ডেভেলপমেন্ট) সমস্যাই হলো অটিজম। অটিস্টরা আমাদের চারপাশের জগত থেকে নিজেদের কিছুটা আড়াল করে রাখে। তাদের নিজস্ব একটা মনোজগতে বসবাস করে। ফলে অনেক সময় এদের আচরণও হয় অস্বাভাবিক। সহজ করে বলতে গেলে এই ধরণের রোগীকে আমরা সাধারণত হাবাগোবা বলেই চালিয়ে দেই। তবে এ ক্ষেত্রে তাদেরকে মানসিক রোগী বলা যাবেনা। আচরণগত সমস্যা হিসেবে মানিয়ে নিতে হবে।


এ ব্যাপারে অকুপেশনাল থেরাপিস্ট ডা. উম্মে সায়কা নীলা বলেন, ‘অটিজম একটি মানসিক বিকাশগত সমস্যা যা সাধারণত জন্মের পর প্রথম তিন বছরের মধ্যে হয়ে থাকে। এই সমস্যার জন্য সামাজিক বিকাশ ও সামাজিক যোগাযোগ যেমন কথা বলা, ভাব বিনিময় করার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। তীব্র আলো, শব্দ, গন্ধ এসব সহ্য করতে পারে না অটিস্টরা। মানুষের সঙ্গে, এমনকি আপন জনের সঙ্গেও ভাববিনিময় করতে পারে না।’

১৯১১ সালে সর্বপ্রথম সুইস মনোবিজ্ঞানী অয়গেন ব্লয়লার অটিজমকে এক ধরনের মনোরোগ হিসেবে চিহ্নিত করেন। কয়েক দশক পরে রোগটি নিয়ে গবেষণা আরো বিস্তৃত হয়।

অটিজমের কারণ:
অটিজম মস্তিস্কের অস্বাভাবিক বায়োলজি ও কেমিস্ট্রির ফলে সৃষ্ট একটি সমস্যা। তবে ঠিক কী কারণে অটিজম হয় এ ব্যাপারে এখনো কোনো সুস্পষ্ট কারণ জানা যায়নি। সারা পৃথিবীতেই এই সমস্যার কারণ জানতে গবেষণা চলছে।

বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করে থাকেন জিনগত ত্রুটির কারণে অটিজম হতে পারে। যেমন কোনো পরিবারে যদি অটিজমের ইতিহাস থাকে তাহলে সেই পরিবারের শিশুটির অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা বেশি।

এছাড়া অটিজমের জন্য আরো কিছু বিষয়কে সন্দেহ করা হয়, এগুলো হচ্ছে গর্ভাবস্থায় খাদ্যাভ্যাস, বাচ্চার অন্ত্রের পরিবর্তনগত সমস্যা, মার্কারির (পারদ) বিষক্রিয়া, বাচ্চার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ পরিপাক করতে না পারা, টীকার প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।

অটিজম কত প্রকার:
অটিজমের কয়েকটি ধরন রয়েছে। এর মধ্যে ক্লাসিক অটিস্টিক ডিসঅর্ডার। যাকে ‘আর্লি ইনফ্যানটাইল অটিজম`-ও বলা হয়। সাধারণত তিন বছর বয়স হওয়ার আগেই এর লক্ষণ দেখা যায়। এতে শিশুর বিকাশে এক সাথে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। যেমন কথা বলার সমস্যা, যোগাযোগ ও বোঝার অসুবিধা ইত্যাদি।

আরেক প্রকারের অটিজম হলো অ্যাসপারজার্স সিনড্রোম। এ ক্ষেত্রে রোগীর স্বাভাবিক কথা বলার ক্ষমতা থাকলেও কারো সঙ্গে মিশতে পছন্দ করে না। বিশেষ কোনো একটি বিষয়ে পারদর্শী হয়, কিন্তু অন্য আরেকটি বিষয়ে কিছুই বুঝতে পারে না।

তবে অটিজম আক্রান্তদের মধ্যে কিছু বিষয়ে বেশ মিল দেখা যায়। তা হলো, তারা সবাই একই ধরনের আচরণ বার বার করে এবং সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না। হঠাৎ রেগে যায়।
কিভাবে বুঝবেন :
প্রাথমিক অবস্থায় ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে-
১। একটি শিশু যদি ১ বছরের মধ্যে মুখে অনেক আওয়াজ না করে, কিংবা আঙ্গুল দিয়ে বা অঙ্গভঙ্গি করে কোনো কিছু না দেখায়।
২। ১৬ মাসের ভেতর যদি এক শব্দের সংমিশ্রণে বাক্য না বলে।
৩। ২ বছরের ভেতর যদি দুই শব্দের সংমিশ্রণে বাক্য না বলে।
৪। একটি শিশুর কথা ও সামাজিক আচরণ যদি হঠাৎ হারিয়ে যায়।
৫। শিশু যদি চোখে চোখ না রাখে।

একটু বয়সীদের ক্ষেত্রে
১। নাম ধরে ডাকলে যদি সাড়া না দেয়।
২। অমিশুক হয় এবং আদর করা পছন্দ করে না।
৩। হঠাৎ করে খেপে ওঠে।
৪। সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না।
৫। কোনো ধরনের আনন্দদায়ক বস্তু বা বিষয় সে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেয় না।
৬। যদি একই শব্দ বা বাক্য বার বার উচ্চারণ করে বা তাকে বলা কোনো কথার পুনরাবৃত্তি করে।
৭। একই আচরণ বার বার করতে থাকে।
৮। আওয়াজ পছন্দ করে না।
৯। খুব বেশি রুটিন মেনে চলতে পছন্দ করে, আশপাশের কোনো পরিবর্তন সহ্য করতে পারে না।

এসব লক্ষণ সাধারণত তিন বছর বয়সের মধ্যে দেখা যায়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে আরেকটু পরেও দেখা দিতে পারে।


অটিজম রোগটির প্রাদুর্ভাব:
বাংলাদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ও বিস্তার সম্পর্কে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশে প্রতি ৫০০ জনে একজনকে অটিস্টিক শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে হিসেবে বাংলাদেশে ২.৫ লাখ শিশু অটিস্টিক। ইন্ডিয়াতেও ৫০০ জনে একজন, আমেরিকায় প্রতি ১০,০০০ জন শিশুর মধ্যে ৪.৫ জন শিশু অটিস্টিক।

বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে অটিজম নিয়ে তেমন কোনো সমীক্ষা হয়নি। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, শুধুমাত্র ঢাকা বিভাগেই অটিস্টিক শিশুর হার শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ (০.৮৪%)।

অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে ১৯৯০-২০০০ সালের মধ্যে। আর এ ক্ষেত্রে ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় বেশি ঝুঁকি সম্পন্ন বলে মন্তব্য করেছে বিজ্ঞানীরা। এর অনুপাত ৪:৩:১। বয়স্ক পিতা অটিজম হওয়ার জন্য বেশি দায়ী বয়স্ক মায়ের তুলনায়। কারণ বেশি বয়স্ক স্পার্ম দিয়ে মিউটেশন কঠিন হয়। অটিজম সাধারণত সকল জাতি, বর্ণ, গোত্র ও দেশে দেখা যায়।

চিকিৎসা:
বাচ্চা অটিস্টিক কিনা তা যাচাই এর জন্য কোনো প্যাথলজিক্যাল টেস্ট নেই। তবে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বাচ্চার আচরণ, পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদি বিবেচনা করে বাচ্চা অটিস্টিক কিনা তা বলতে পারেন। অটিজম এমন একটি কন্ডিশন যা কখনো পুরোপুরি ভালো হবার নয়। এটাকে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হয়। দ্রুত নির্ণয় করা গেলে অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসায় ভাল ফল পাওয়া যায়। অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রধান রওনক হাফিজের মতে, অটিজম বিষয়ে যতদ্রুত চিকিৎসা নেওয়া যাবে তত দ্রুতই ভাল ফল পাওয়া যাবে।

এই চিকিৎসা হচ্ছে একটি সমন্বিত চিকিৎসা যা পেডিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞ, নিউরো রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট এবং ক্ষেত্র বিশেষে ফিজিওথেরাপিস্ট এর সহযোগিতা নিতে হয়। আর প্রতিটি অটিস্টিক শিশুর জন্য আলাদা আলাদাভাবে চিকিৎসা পদ্ধতি নিরূপন করা হয়।


অটিজম প্রতিরোধে কিছু উদ্যোগ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বাংলাদেশ জাতীয় অটিজম উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান। তার উদ্যোগে সরকারি পর্যায়ে অটিজম নিয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেমন সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে মিরপুরে চালু হয়েছে ‘অটিজম রিসোর্স সেন্টার`। আর অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, অটিস্টিক শিশুদের অবস্থা পরিমাপসহ আরো অন্যান্য প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠন করা হয়েছে ‘সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিলড্রেন`।

শিশুর অটিজম বিষয়ে পরামর্শ পাবেন যেখানে

বর্তমানে বাংলাদেশে অটিজম নিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছে। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে বেশ কিছু সংস্থা। ‘অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন’ এদের মধ্যে অন্যতম।


ঢাকার শিশু হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের শিশুবিকাশ কেন্দ্রে অটিজম বিষয়ের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকায় ডা. রওনক হাফিজ, ডা. লিডি হক ও ডা. মল্লিক এবং চট্টগ্রামে ডা. বাসনা মুহুরী অটিজম নিয়ে কাজ করছেন।

ঢাকায় অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, এসডব্লিউএসি (সোয়াক), কেয়ারিং গ্লোরি, বিউটিফুল মাইন্ডসহ এ রকম বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করছে।

এ ব্যাপারে ঢাকার সরকারি শিশু হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্রের চিকিৎসক শিশু মনোবিজ্ঞানী ডা. সালমাআকরাম জানান, অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘অটিস্টিক শিশুরা কখনো দেশের বোঝা নয়। পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলে অনেক ক্ষেত্রে তারা ভাল করতে পারে। অটিস্টিক শিশুরা দেশের সম্পদে পরিণত হতে পারে।’

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন