বৃহস্পতিবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৫

মণিপুরিদের অহঙ্কারের প্রতীক এস কে সিনহা

তিনি প্রমান করেছেন জীবনের লক্ষ যদি থাকে স্থির আর সেটাতে থাকা যায় অবিচল ও কর্মনিষ্ট তাহলে সে লক্ষ অর্জিত হবেই। তিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর। ইতিহাস গড়ে হয়ে উঠেছেন পুরো মণিপুরি জাতির অহঙ্কারের প্রতীক। তিনি আর কেউ নন। তিনি হলেন বাংলাদেশের নতুন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।

উঠে এসেছেন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার তিলকপুর নিভৃত পল্লীর এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। কর্মজীবনে প্রবেশের শুরুতেই শপথ নিয়েছেলেন এ ভুবনের শীর্ষে পৌঁছুবেন একদিন। গত ১৭ই জানুয়ারি লালিত সেই স্বপ্নের শেষ সীমা ছুঁলেন তিনি। বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেনে তিনি। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম অমুসলীম প্রধান বিচারপতি।

এস কে সিনহার পুরো নাম সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। আপনজনরা ডাকে সুরেন নামে। ১৯৫১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার নিভৃত পল্লী তিলকপুর গ্রামে তার জন্ম। উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে অনেক দূরে থাকলেও গ্রামটিতে শিক্ষার আলো জ্বলছিল  অনেক আগে থেকেই। স্কুল শিক্ষক ললিত মোহন সিনহা ও ধনবতী সিনহার দ্বিতীয় সন্তান এস কে সিনহা পড়ালেখার পাঠ শুরু করেন গ্রামের রানীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ভর্তি হন কমলগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর এস কে সিনহা গ্রাম ছেড়ে আসেন সিলেটে। শিক্ষার্থী হিসেবে নাম লেখান সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ মদন মোহন কলেজে। সেখান থেকে ১৯৬৮ সালে পাস করেন উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৭০ সালে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এলএলবি ডিগ্রি নেওয়ার পর ১৯৭৪ সালের ১৯শে ডিসেম্বর আইন পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন তিনি।

আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন সিলেট জেলা জজ কোর্টে। সিলেটের প্রথিতযশা আইনজীবী সুলেমান রাজা চৌধুরীর জুনিয়র হিসেবে প্র্যাকটিস শুরু করেন। থাকতেন নগরীর তাঁতিপাড়ায়। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সিলেটেই ছিলেন। ’৭৮ সালে হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে নাম লেখান তিনি। ১৯৯০ সালে এস কে সিনহার পরিচিতি হয় আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে। স্বনামধন্য আইনজীবী এস আর পালের জুনিয়র হিসেবে আইন পেশা চালিয়ে যান হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার আগ পর্যন্ত। ১৯৯৯ সালের ২৪শে অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে যোগ দেন এস কে সিনহা। ১০ বছর পর ২০০৯ সালের ১৬ই জুলাই তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। সবশেষ গত ১৭ই জানুয়ারি, বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন তিনি।

বাবা ললিত মোহন সিনহা চেয়েছিলেন সরকারি কোন চাকরি নিয়ে নিশ্চিত জীবনে থিতু হন ছেলে। তবে সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহী ছিলেন না এস কে সিনহা। সুযোগ এসেছিল তবে চোখ ফেরাননি সেদিকে। হৃদয়জুড়ে ছিল আইনের ঘর-বারান্দা। শপথ ছিল মনে এ ভুবনের শীর্ষে পৌঁছুবেন একদিন।

স্বপ্নের মতো সাজানো এস কে সিনহার ব্যক্তিজীবনও। ১৯৭৮ সালের ২ জুলাই কমলগঞ্জের মাধবপুর ইউনিয়নের জবলারপার গ্রামের সমরেন্দ্র কুমার সিনহা ও হেমলতা সিনহার বড় মেয়ে সুষমা সিনহার সঙ্গে ঘর বেঁধেছিলেন এস কে সিনহা। সুখী সংসারে তার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে সূচনা সিনহা অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী, স্বামী বিদ্যুৎ প্রকৌশলী। ছোট মেয়ে আশা সিনহা স্বামীর সঙ্গে কানাডায়।

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বড় ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহা মার্কেন্টাইল মেরিন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী, থাকেন চট্টগ্রামে। একমাত্র বোনটি তার ছোট, সত্যবামা দেবী ২০০৯ সালে মারা গেছেন। ছোট দুই ভাইয়ের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা নীলমণি সিনহা গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। সব চেয়ে ছোট ভাই অনন্ত কুমার সিনহা পেশায় দন্ত চিকিৎসক, থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে।

ব্যস্ত জীবনে খুব কমই অবসর মেলে এস কে সিনহার। সেটারও মাপা মাপা ব্যয় করেন তিনি। তার স্ত্রী সুষমা সিনহা মানবজমিনকে বললেন, অবসর পেলে গান শুনেন বাংলাদেশের নতুন প্রধান বিচারপতি। রবীন্দ্র সংগীতই তার পছন্দের তালিকায়। খাবারে তেমন বাছবিচার না থাকলেও দুর্বলতা রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভর্তার প্রতি। কোষ্ঠী  বিচারে তিনি তুলা রাশির জাতক। পোশাক হিসেবে প্রথম পছন্দ পাঞ্জাবি-পায়জামা। কাছে টানে হালকা ধরনের রঙগুলো।

কেমন মানুষ এস কে সিনহা। তার সহপাঠী-বন্ধুদের সঙ্গে আলাপে বুঝা যায় ‘সুরেন’ সবার প্রিয়ই। স্কুল জীবনের সহপাঠী ও ভগ্নিপতি রায়মোহন সিংহ জানান, তিনি যে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান- একথাটি সব সময়ই স্মরণে রাখেন এস কে সিনহা। সব সময়ই সততার প্রতি খেয়াল রেখেই এগিয়ে গেছেন। রায়মোহন সিংহ বলেন, পড়াশোনায় কোন বিরতি নেই তার। শত ব্যস্ততার মাঝে ফাঁক পেলেই বইয়ের পাতা চোখের সামনে মেলে ধরেন এস কে সিনহা।

এস কে সিনহার বাল্যবন্ধু অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ। বন্ধুকে নিয়ে বেশ গর্বই তার। বললেন, এতো উঁচু মাপের মানুষ তবে এতটুকু বদলে যায়নি সুরেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও ও আমার সঙ্গে নিয়মিতই ফোনে আলাপ করে। প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরও ওর সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছে।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন