বুধবার, ২৫ মার্চ, ২০১৫

সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানির সমস্যা ও সম্ভাবনা

দীর্ঘ ৬ বছর পর সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য বড় সুখবর। কিন্তু বর্তমান সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা জনশক্তি রপ্তানির এই সুযোগ পুরুষের পরিবর্তে নারী শ্রমিকদের জন্য! তাও আবার পেশার দিক দিয়ে মান মর্যাদাহীন গৃহকর্মী (খাদ্দামা)। সৌদি আরবের গৃহকর্মীদের খাদ্দামা বলেই ডাকা হয়!

বেসরকারি হিসেবে সৌদি আরবে বর্তমান ২৬ লাখ ১৫ হাজারের অধিক বাংলাদেশি শ্রমিক সৌদি আরবে কর্মরত রয়েছে। বর্তমান বিশ্বে সৌদি আরবই বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার। ৬ বছর একটানা ভিসা বন্ধ না থাকলে বর্তমান সৌদি আরবে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা অর্ধকোটি ছাড়িয়ে যেত। 


 ২০০৭ সালে সৌদি তৎকালিন বাদশা সালমান-বিন-আবদুল আজিজের প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা প্রহরীকে খুন ও ডাকাতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় একাধিক বাংলাদেশিকে। ২০০৬-২০০৭ সালের নানা অপরাধ পর্যালোচনা করে। সৌদি আরবে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পর্ষদ (শরিয়াহ বোর্ড) এর সিদ্ধান্ত ক্রমে বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধ করা হয়। এবং ওই ঘটনায় দীর্ঘ বিচার কার্যক্রম পর্যালোচনা শেষে অভিযুক্তদের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১১ সালে ৮ বাংলাদেশিকে শিরচ্ছেদ করা হয়।

 একই বছর বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে হত্যা ডাকাতিসহ আরও অনেক অভিযোগ এনে বাংলাদেশি ভিসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশি ভিসা বন্ধ করার ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানি মালিকানাধীন মধ্যপ্রাচ্য ও সৌদি আরব থেকে স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত দৈনিকগুলো ব্যাপক ভূমিকা রাখে। মূলত এই সব দৈনিকে অপপ্রচারের কারণেই বাংলাদেশি ভিসা বন্ধ হয়ে যায়।

 মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি মালিকানাধীন গণমাধ্যমের অনুপস্থিতি ও সৌদি আরবের প্রভাবশালী দৈনিক গুলোতে ইন্ডিয়ানদের ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের কারণে সৌদিদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বাংলাদেশিদের সুনাম ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হতে থাকে। এক পর্যায়ে বাংলাদেশি ফ্যামিলি ভিসা থেকে শুরু করে সব ধরনের ভিসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। 

এছাড়া সৌদি আরবে যে পাঁচ লাখের অধিক রোহিঙ্গা রয়েছে। বাংলা ভাষাভাষি হওয়ায় মায়ানমারের রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে থাকেন। সৌদি আরবে নানা অপরাধের সাথে এসব রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততা আছে বলে বিভিন্ন সংস্থা দাবি করেছে। চেহারা ও ভাষার মিল থাকায় অপরাধ সংঘটনের পরপরই দোষ চাপিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশিদের উপর। এই কারণেও প্রবাসী বাংলাদেশিরা নানা সমালোচনার সম্মুখীন হয়ে থাকেন।

দীর্ঘ ছয় বছরের আমার সৌদি প্রবাস জীবনের নানা অর্জন ও অভিজ্ঞতার নিরিখে আমি সৌদি আরবে নারী শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার চেয়ে সমস্যায় বেশি দেখছি। মূলত দুটি কারণে সৌদি আরবে নারী শ্রমিক প্রেরণ হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সালে সৌদি আরবে নারী শ্রমিক প্রেরণের চুক্তি অনুসারে প্রতি মাসে ১০ হাজার হলে ১২ মাসে ১ লাখ ২০ হাজার নারী শ্রমিক সৌদি আরবে গেলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস্ সেক্টরের কি হবে? তা ভেবে না দেখে বাংলাদেশির উল্লাস দেখে পাগলের বিলাপ বলেই মনে হয়েছে আমার। দুঃখ  ও পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, বিশ দলীয় জোট নেত্রী, স্পীকারসহ দেশের শীর্ষ স্থানীয় পদে যে দেশের নারীদের অগ্রায়ন হয়েছে সেদেশের নারীরা বিদেশে গৃহকর্মী হয়ে গেলে দেশ কিভাবে মাথা তুলে দাঁড়াবে?

ব্যাপক ডাক ঢোল পিটিয়ে ১৪ সালের শেষ পর্যায়ে আরব আমিরাতে ও বাংলাদেশি গৃহকর্মী প্রেরণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। গত ৪ মাসে আরব আমিরাতে কত নারী শ্রমিক গিয়েছে তার হদিছ নেই। এছাড়া  হংকংসহ আরও অনেক দেশে বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী নেওয়ার চুক্তি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ যেন গৃহকর্মী উৎপাদনের দেশে পরিণত হয়েছে। যে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কথা হচ্ছে.. সেদেশের নারীদের বিদেশে গৃহকর্মী হওয়া কতটা মানসম্মানের তা চুক্তিকর্তারাই ভালো জানেন! 

এছাড়া সৌদি আরবে যেসব নারী শ্রমিক যেতে আগ্রহী হবেন তাদের বয়স ও শারীরিক অবস্থা এবং পরিচ্ছন্নতা সৌদি আরবের গৃহকর্তা নয় স্বয়ং গৃহকর্তীদেরও পছন্দ হবে কি না সন্দেহ রয়েছে! 

কারণ সেদেশে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশের ইংরেজী জানা শিক্ষিত গৃহকর্মীদের দারুণ দারুণ সব সার্ভিস দিয়েছে! সেদেশে বাংলাদেশের মত অজোপাড়া গায়ের অশিক্ষিত মেয়েরা ভিন দেশের ভিন্ন পরিবেশে কতটা মানিয়ে নিতে পারবেন? 
এছাড়া বাংলাদেশের এসব মেয়েরা খাদ্য সংকটেও পড়বে। কেননা সৌদি পরিবারগুলোতে বাংলাদেশের মত ভাত ও তরিতরকারি রান্না হয় না। সেদেশগুলোতে রান্না ঘরের কাজ না থাকলেও যার যত বিত্ত তার তত খাদ্দামা (গৃহকর্মী) রাখার সংস্কৃতি রয়েছে। সব গৃহকর্মীদের অত্যাচারই যেমন সত্য নয়, তেমনি সব গৃহকর্তাও সাধু নয়।

কথা হচ্ছে মাসের পর মাস খেটে বেতন না পেয়ে গৃহকর্মীরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সৌদি আরবে আমার প্রবাস জীবনের দীর্ঘ ৪ বছর অবস্থান ছিল জেদ্দার কিলো তামানিনস্থ  বাংলাদেশ দূতাবাসের সন্নিকটে। 

আমার দীর্ঘ ৪ বছরের অভিজ্ঞতায় আমি কোনো ভূক্তভোগী বাংলাদেশিকে দূতাবাসের সেবা পেতে দেখিনি! দিনের পর দিন বাংলাদেশ দূতাবাস অফিসে এসে সমস্যার কথা বড় কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি অসহায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা। 

 যাদের রক্ত ও ঘামের বিনিময়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা তরান্বিত হচ্ছে সেই প্রবাসী বাংলাদেশিদের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ দূতাবাস! সংকট সমাধানে কতটা অসহায় তা কেবল ভূক্তভোগীরাই জানেন। দূতাবাসের কর্মকর্তারা দামী গাড়ি নিয়ে বড় বাড়িতে সরকারি অর্থ খরচ করে বিলাসী জীবন যাপনই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রবাসী শ্রমিকদের কোনো মূল্যায়ন-ই হয় না দূতাবাসে। রাজনৈতিক বিবেচনায় দূতাবাসের নিয়োগ বদলি বিবেচিত হওয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা কর্মকর্তারা রাখতে পারেন না কিংবা রাখেন না! 

সৌদি আরবে বন্ধ ভিসা চালু হওয়ার খবরে ২৬ লাখ সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশিরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে। সংবাদকর্মী হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা গত এক মাসে কয়েক'শ বার ফোন করে জানতে চেয়েছেন আমার কাছে আসলেই কি ভিসা বের হচ্ছে? নাকি নারী শ্রমিক প্রেরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

 সৌদি ভিসা চালু হবার খবরে ২৬ লাখ প্রবাসী ২ কোটিরও বেশি আত্মীয়-স্বজনের মুখে হাসি ফুটে। ফলে খবর প্রকাশের এক দিনের মধ্যে গত ২ ফেব্রুয়ারি জেলায় জেলায় জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ে পুরুষদের দীর্ঘ লাইন পরিলক্ষিত হয়। সরকারিভাবে নিবন্ধনের কথা বলায় নারী শ্রমিকের ভিসার জায়গায় পুরুষ শ্রমিকের এই দীর্ঘ লাইন পরিলক্ষিত হচ্ছে। 

বিদেশ যেতে নিবন্ধনের জন্য এই দীর্ঘ লাইন বলে দেয় বাংলাদেশের মানুষ অকর্মা নয়। দেশ কর্মসংস্থান দিতে ব্যর্থ হওয়ায় নাগরিক জীবন অস্থির হয়ে উঠেছে। সম্ভবত বাংলাদেশই এশিয়া মহাদেশের মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সর্বোচ্চ দেশে পরিণত হয়েছে।

 জীবনের স্বাদ আহ্লাদ পূরণ করতে না পেরে অনেক তরুণ বিপথগামী হচ্ছে। জড়িয়ে পড়ছেন অসামাজিক ও অবৈধ কর্মকা-ে। একজন কর্মবীর মানুষের দৈনিক খরচের পরিমাণের চেয়ে একজন বেকারের খরচ অনেক বেশি। বাবার হোটেলের তিন বেলা খাবার ফ্রি হলেও মোবাইল বিল, ইন্টারনেট খরচ শ্বাস-নিঃশ্বাসের মত প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে এই বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হবে তাহলেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে।

নাজিম উদ্দিন চৌধুরী এ্যানেল
লেখক, সংগঠক ও কলামিস্ট
nazimabnews24@gmail.com

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন