রবিবার, ১৪ মে, ২০১৭

আমার মা: জীবন সংগ্রামে হার না মানা এক মহিয়সী নারী

হাসপাতালের বারান্দায় আমি আর মা
'মা'। সম্ভবত পৃথীবির সবচে ছোট তবে সবচে বড় অনুভুতির একটি শব্দ। হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখেও মায়ের মর্ম সঠিকভাবে উত্থাপন সম্ভব নয়। আমাদের অনুভুতি, যাপিত জীবন সবকিছুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছেন মা। মা ছাড়া এই পৃথীবি নি:সন্দেহে অন্ধকার।
ব্যাক্তি জীবনে আমার মা- কে নিয়ে ব্যাখা করার মতো সঠিক কোন বাক্য খুঁজে পাইনা। হয়তো একটা বই ই লিখে ফেলতে পারব- 'আমার মা কে যেমন দেখেছি' এমন শিরোনামে। ছোট বেলা থেকে আমি মারাত্নক ডানপিটে থাকার কারনে অসম্ভব রকম জ্বালিয়েছি মা কে বাবাকে।
তবে জীবন জীবিকার তাগিদে বাবা প্রবাসী জীবন বেছে নেয়ার কারনে মা-ই হয়ে উঠেন আমাদের তিন ভাই বোনের একমাত্র অভিবাবক। লেখাপড়া, জীবনাচার, লেনদেন, লোক সমাজে চলাফেরা সব কিছুতেই মা আমাদের গাইড।
যদিও তিনি নিজে লেখা পড়ায় প্রাথমিকের গন্ডি পার হতে পারেননি, কিন্তু জ্ঞানে আমি  ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্রাজুয়েশন করেও তাকে টপকাতে পারিনি এখনো। আমার অন্য ভাই বোনরাত নয়ই। মা যখন প্রথম আমাদের বাড়িতে আসেন তখন তার বয়স ছিল তের কি চৌদ্দ। অথচ এই অল্প বয়সে, শিশুকালেই তিনি যে দক্ষতায় আমাদের সংসারের দায়িত্ব কাধে নিয়েছিলেন, আমরা ভাই বোনরা তারচে দ্বিগুন বয়সের হয়েও এখনও সেই দায়িত্বটা বুঝেই উঠতে পারিনি। সক্ষমতাতো দুরের কথা। 

 ক্যালেন্ডারের পাতাগুনে বয়স হয়তো হয়েঁছে ঠিকই ২৭ কিংবা ২৮। কিন্তু তার কাছে এখনো ৭/৮ বছরের শিশু থেকে বেশি বড় হতে পারিনি। দেশের কত প্রান্তে ঘুড়ে বেরিয়েছি, কত মানুষের সাথে চলাফেরা করেছি, করছি নিত্যদিন, কিন্তু মানুষ চেনায় এখনো তার কাছে আনাঢ়ি। অর্ধেকটাও প্রজ্ঞাবান হয়ে উঠতে পারিনি।
প্রতিদিন কত চ্যালেঞ্জিং কাজ করি, অথচ এখনো মায়ের মতো অতটা সাহসীই হয়ে উঠতে পারিনি। যখনই কোন কাজে বুকটা দুরু দুরু করে ভেঙ্গে পরি তখন মা সাহস যোগান।
একটা ঘটনা না বললেই নয়, সে বার আমি যখন চরম বিপদে পড়লাম। গুম হয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলাম, তখন আমার ধারনা হয়েছিল আর কোন দিন হয়তো পৃথিবীর আলো দেখবোনা। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবো না। তখন পৃথীবির জন্য নয় শুধু আমার মায়ে মুখটা কল্পনা করেই কেঁদেছি দিন রাত। তবে সপ্তাহ দুই পর যখন জীবনে কিছুটা আশার আলো ঝলকানি দিল তখন ভেবেছিলাম মায়ের সাথে প্রথম সাক্ষাতে অামি খুব শক্ত থাকবো। কারন আমার দুরবস্থা জানলে মা হয়তো অনেক কষ্ট পাবে।   কিন্তু কিসের কী! মা কে দেখেই আমার হৃদয় ভেঙ্গে কান্না চলে এলো। আমি যখন হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলাম, তখন আমার মা আমাকে অবাক করে দিয়ে বীরের মতো, একজন সেনাপতির মতো আমাকে সাহস দিলো। বললো বাবা, কাঁদো কেন? তুমি না পুরুষ মানুষ। সেই দিন আমি তার চোখে এক ফোঁটা পানিও দেখিনি বরং তার চোখে দেখেছিলাম দৃঢ়তার ঝলকানি। তার সেই সাহসী ভুমিকা আমাকে প্রেরনা যুগিয়েছে শত কষ্টের মাঝেও দাত কেলিয়ে হাসার। এনে দিয়েছে দুনিয়াকে তুচ্ছ করার মানসিক শক্তি । যেটা আমার কল্পনাতেও ছিলনা। কঠিন বিপদে একজন দুর্বল মহিলা কীভাবে হারমানা সৈনিকের মনোবল ফিরিয়ে দিতে পারে তার উদাহরন আমার মা।
মায়ের যোগানো সেই সাহস আমাকে অারো অনেক দুর নিয়ে যাবে, পৃথিবীকে জয় করার শক্তি এনে দিবে এটাই আমার বিশ্বাস।

শুধুকি সাহস আর বুদ্ধিমত্তা! যাপিত জীবনে ফ্যাশন, লাইফস্টাইলেও মায়ের কাছে খ্যাত ছাড়া ভালো কোন পদবি পাইনি এখনো। 

মা কে ছাড়িয়ে যাওয়ার আমার এ ইচ্ছা সেই ক্লাস সেভেন কি এইট থেকেই। সেই থেকে অদ্যবধি একটাই চেষ্টা করে যাচ্ছি জীবনের সব ক্ষেত্রে মা-কে ছাড়িয়ে যাবার। কিন্তু আজও তার ধারে কাছে যেতে পারিনি। মাঝে সাঝে তাকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করি কিন্তু পরক্ষনেই কুপোকাত। বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে হয় তার কাছেই, নত হয়ে বলতে হয় ভুল হয়ে গেছে। তবে এত কিছুর পরও মা চিরস্থায়ী রাগ করেন না। যদিও সাময়িক বকাঝকা করে, তবে বুঝতে পারি এটা তার রাগ না অভিমান। সবক্ষেত্রে তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারলে তিনিই হয়তো সবচে বেশি খুশি হবেন।

যাই হোক জীবন যুদ্ধে মা আমার এখন অনেকটাই ক্লান্ত। বয়সের ভারে না হলেও দায়িত্বের ভারে কাবু তিনি। বুঝতে পারি, তিনি এখন আর অাগের মতো অতটা চাপ সইতে পারেননা। তবুও তিনি এখনো অদম্য। তার এত সংগ্রামের পরেও আমরা ভাইবোনরা এখনো সু প্রতিষ্ঠিত না হতে পারায় তিনি আরো বেশি ভেঙ্গে পড়ছেন। প্রায় রাতেই দেখি ঘুমের ঘোরে আমার/আমার ভাইয়ের নাম ধরে কেঁদে উঠেন। গোঙ্গানি দিতে দিতে আবার ঘুমিয়ে পড়েন।  তখন কষ্টে বুকটা ভেঙ্গে যায়। রাগা রাগি করি, বলি এতটা চিন্তা করার কী আছে আমাদের নিয়ে। আল্লাহতো একটা ফয়সালা করেই রেখেঁছেন আমাদের জন্য। তবুও তিনি ভাবনাহীন হতে পারেন না।
মা কে ছাড়িয়ে যাবার এই খেলায় নেমে, এখন দেখছি আমার মায়ের আরেক উল্টো রূপ। তাকে যতটা সাহসী মনে করতাম, আমাদের ব্যার্থতায় তিনি ততটাই দুর্বল। আমরা একদিন আরো বড় হবো, আরো স্বাবলম্বি হবো, সবকিছু ঠিক ঠিক বুঝে নেব, এমন হাজারো আশার বানী তাকে আশ্বস্ত করতে পারেনা কিছুতেই।
জীবন যাপনের এতো এতো সমীকরনে যে কথাটি কখনোই মুখ ফুটে বলা হয়নি, আমরা তাকে কতটা ভালোবাসি, কতটা অনুভব করি। তাকে ছাড়াযে আমাদের জীবনটাই অন্ধকারে ঢেকে যাবে।

যাই হোক, পৃথীবির সব মায়েরাই সুন্দর। অনন্য তাদের ভালোবাসা, মমতা। জীবন সংগ্রামে হার না মানা এক মহিয়সী নারী মা। সন্তানের ভবিষ্যত ভবিষ্যত করে যে তার অতীত বর্তমান ভবিষ্যত সব হারিয়েছে। আজকের এ দিনটাতে পৃথীবির সব মা য়ের জন্যই রইল ভালোবাসা। 

1 মন্তব্য(গুলি):