নিঃসঙ্গতার একশ বছর
মূল: গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ( অনুবাদ: আনিসুজ্জামান)
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর মতো আর কোনো উপন্যাস প্রকাশের পরপরই
এতটা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে কিনা সন্দেহ। জনপ্রিয়তার বিচারে যেমন, তেমনি শিল্পকুশলতা আর শিল্পমুক্তির ক্ষেত্রেও এটি হয়ে উঠেছে
এক অনন্য দৃষ্টান্ত। কেবল স্প্যানিশ সাহিত্যেই নয়, গোটা বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসেই একটি মাত্র উপন্যাসে ইতিহাস, আখ্যান, সংস্কার,
কুসংস্কার, জনশ্রুতি,
বাস্তব, অবাস্তব,
কল্পনা, ফ্যান্টাসি,
যৌন-অযাচার ও স্বপ্ন– সবকিছুর এমন স্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য সহাবস্থান আগে কখনও দেখা যায়নি।
বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত কিংবদন্তিতুল্য এই উপন্যাসটি মূলভাষা থেকে অনূদিত হয়নি।
এক ::
বহু বছর পর, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে যাবে সেই
দূর বিকেলের কথা, যেদিন তার বাবা তাকে বরফ চেনাতে নিয়ে গিয়েছিল। তখন মাকোন্দ প্রাগৈতিহাসিক
ডিমের মতো প্রকাণ্ড, মসৃণ আর সাদা পাথরের পাশ দিয়ে বয়ে-চলা কাকচক্ষু
নদীর পাশে মাটি আর নল দিয়ে তৈরি বিশটি বাড়ির এক গ্রাম। তখন পৃথিবী ছিল এতই নতুন যে বহু কিছুই ছিল
নামের অপেক্ষায়, আর ওগুলোর উল্লেখ করতে হলে আঙুলের ইশারায়
বুঝিয়ে দিতে হত। প্রতি বছর মার্চে ছন্নছাড়া এক জিপসি পরিবার গ্রামের পাশে তাঁবু খাটাত আর বাঁশি
খোল-করতালের হল্লা তুলে দেখিয়ে বেড়াত নিত্যনতুন সব আবিষ্কার। প্রথমবার তারা আনে চুম্বক, বাবুইপাখির পায়ের মতো সরু লিকলিকে হাতওয়ালা দশাসই চেহারার আর
বেয়াড়া রকমের দাড়ি-গোফওয়ালা জিপসি মেলকিয়াদেস দেখিয়েছিল এক জবরদস্তু প্রদর্শনী,
যা ওর মতে মেসিদোনিয়ার আলকেমিদের আবিষ্কৃত অষ্টমাশ্চার্য। দুই ধাতবপিণ্ড টানতে
টানতে বাড়ি বাড়ি যায় সে আর গামলা, পাইলা, কড়াই, চুলা আর আংটাগুলো সব
যার যার জায়গা থেকে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এসে সবাইকে তাজ্জব করে দেয়। এমনকি বহু দিন আগে
থেকে খুঁজে না-পাওয়া জিনিসগুলো বেরিয়ে আসে একই জায়গা থেকে, যেখানে সবচেয়ে বেশি খোঁজা হয়েছিল, আর স্ক্রু-পেরেকগুলো
বেরিয়ে না আসতে পারার যন্ত্রণায় ক্যাচকেচিয়ে ওঠে। জাদুকরি লোহার পিছনে সব টানতে টানতে জিপসিদের
অপরিশীলিত উচ্চারণে মেলকিয়াদেস ঘোষণা করে, “সব জিনিসেরই নিজস্ব প্রাণ আছে; এ হচ্ছে কেবল ওদের
আত্মাকে জাগিয়ে তোলার ব্যাপার।”
হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার ব্যাপারে কল্পনার
কাছে হার মানত প্রকৃতির উদ্ভাবনী, এমনকি অলৌকিক ব্যাপার
স্যাপার বা জাদুর ভেলকি। ওর কাছে মনে হল অকেজো এই আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর পেট
থেকে সোনা তোলা যাবে। সৎ মানুষ মেলকিয়াদেস ওকে সতর্ক করে, “এ কাজে ওটা
লাগবে না।”
কিন্তু হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তখন জিপসিদের
সততায় বিশ্বাসী ছিল না, ফলে নিজের খচ্চর ও
এক জোড়া ছাগলের বদলে কিনে নেয় চুম্বকপিণ্ড দুটো। ওর বৌ উরসুলা ইগুয়ারান, যার ভরসা ছিল জন্তগুলো দিয়ে পালটাকে বাড়িয়ে তোলা, সে তাকে নিবৃত করতে পারে না।
“শিগ্রী এত সোনা হবে যে সারা বাড়ি মুড়ে ফেলার
পরও আরও বেঁচে থাকবে,” স্বামী উত্তর দিল।
ওর ধারণার সত্যতা প্রমাণের জন্য পরের ক’মাস সে প্রচুর খাটে। উচ্চস্বরে মেলকিয়াদেসের মন্ত্র জপতে জপতে এলাকার প্রতি ইঞ্চি
সে চষে ফেলে, এমনকি নদীটার তলা পর্যন্ত। এতে একমাত্র সে তুলতে পারল লাউয়ের খোলের মতো ফাঁপা, পাথরে ভর্তি পঞ্চদশ শতকের এক বর্ম, যার প্রতি অংশ মরিচা-ধরা টুকরো দিয়ে জোড়া দেওয়া। যখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ও তার অভিযানের
চার সঙ্গী বর্মটাকে খুলে ফেলতে পারল, আবিষ্কার করল
তামার লকেট গলায় চুন হয়ে যাওয়া এক নরকংকাল আর লকেটের ভেতরে নারীর একগোছা চুল।
মার্চে ফিরে এল জিপসিরা। এবার তারা নিয়ে এল
আমস্টার্ডামের ইহুদিদের সর্বশেষ আবিষ্কার একটা দুরবিন আর বড় গোলাকৃতির এক আতশকাচ। গাঁয়ের একমাথায় এক
জিপসি মেয়েকে বসিয়ে অন্য মাথায় তাঁবুতে লাগাল ওরা দুরবিনটাকে। পাঁচ রেয়ালের বদলে লোকজন চোখ লাগাতে পারত
দুরবিনটায় আর মেয়েটাকে দেখতে পাওয়া যেত এক হাত দূরত্বে। “বিজ্ঞান দূরত্বকে নিকেষ করেছে” মেলকিয়াদেস ঘোষণা দিল। “শীঘ্রই লোকে ঘর থেকে না বেরিয়েই দেখতে পাবে
পৃথিবীর সর্বত্র কী হচ্ছে।”
এক রৌদ্রতপ্ত দুপুরে প্রদর্শিত হল বিশাল সেই
কাচ দিয়ে এক আশ্চর্য ঘটনা: রাস্তার মাঝে এক গাদা খড় রেখে সূর্যরশ্মি কেন্দ্রীভূত করে
তাতে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, তখন চুম্বকের ব্যর্থতার সান্তনা পায়নি, তবু এই নতুন আবিষ্কারটাকে হাতিয়ার হিসেবে লাগানোর এক বুদ্ধি আসে তার মাথায়। আবার তাকে বিরত করার
চেষ্টা করে মেলাকিয়াদেস। কিন্তু আতশকাচের বদলে সেই চুম্বকপিণ্ড দুটো আর তিনটে ঔপনিবেশিক
যুগের স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করতেই হয় তাকে।
হতাশায় কেঁদে ফেলে উরসুলা। স্বর্ণমুদ্রাগুলো ছিল
ওর বাবার বঞ্চিত জীবনের সিন্দুকে জমানো ভান্ডারের একাংশ, যা উরসুলা বিছানার নিচে মাটিতে পুতে রেখেছিল কোনো এক জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের
জন্য। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া,
এমনকি স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেবারও প্রয়োজনবোধ করে না,
নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করে কৌশলগত
পরীক্ষানিরীক্ষায়। সূর্যরশ্মি কেন্দ্রীভূত হয়ে শত্রুসেনার উপর কী রকম কাজ করে তা দেখার জন্য নিজের
গা পুড়িয়ে ফেলে আর সেই ঘা সারতে তার অনেক সময় লেগে যায়। এই বিপজ্জনক আবিষ্কারের ভয়ে ভীত স্ত্রীর সমস্ত
প্রতিবাদ ও সতর্কতা সত্ত্বেও সে প্রায় বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছিল। তার নতুন এই হাতিয়ারের
কৌশলগত সম্ভাবনা নিয়ে হিসেব-নিকেশ করে কাটিয়ে দেয় দীর্ঘসময় নিজের কক্ষে যতক্ষণ পর্যন্ত
না তৈরি করতে সফল হল শিক্ষণীয় এক আশ্চর্য স্বচ্ছ নির্দেশিকা আর অর্জন করল এক দুর্দমনীয়
আত্মবিশ্বাস। তার পরীক্ষানিরীক্ষার প্রমাণ আর বিভিন্ন বর্ণনামূলক অংকন সে পাঠিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষের
হাতে।
পাহাড় ডিঙিয়ে জলাভূমিতে পথ ভুলে, পায়ে হেটে খরস্রোতা নদী পেরিয়ে প্লেগ, হতাশা আর বন্য জন্তুর উৎপাতে প্রায় খরচের খাতায় চলে যেতে যেতে
বেঁচে যায় ডাক-বওয়া খচ্চরগুলোর পথের দিশা পেয়ে, রাজধানী পর্যন্ত যাওয়া সে সময় প্রায় অসম্ভব ছিল। তথাপি হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া দিব্বি করে
বসে যে সরকারি হুকুম পেলেই সে রওনা হয়ে যাবে। হাতে কলমে সামরিক কর্তৃপক্ষকে সৌরযুদ্ধের
জটিল বিদ্যায় প্রশিক্ষিত করে তুলবে। তারপর অনেক বছর সে জবাবের আশায় ছিল। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করে ক্লান্ত হয়ে মেলকিয়াদেসকে
নিজের উদ্যোগের ব্যর্থতার কথা দুঃখ করে জানাল। এই সময় জিপসি ওকে সততার প্রমাণ হিসেবে আতসকাচের
বদলে সে ফিরিয়ে দিল পিণ্ড দুটো আর কিছু পর্তুগিজ মানচিত্রসহ নৌ-চালনার যন্ত্রপাতি। সঙ্গে ছিল নিজহাতে
লেখা সাধু হেরমানের পরীক্ষার সংক্ষিপ্তাকার, যাতে করে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া অ্যাস্ট্রল্যাব দিকদর্শনযন্ত্র আর সেক্সট্যান্টাকে
কাজে লাগাতে পারে। বর্ষা মওসুমের লম্বা মাসগুলো সে কাটিয়ে দিল বাড়ির ভেতর দিকটায় ছোট্ট একটা ঘরে যাতে
করে কেউ তার পরীক্ষা নিরীক্ষায় বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে কাটিয়ে দিল
রাতের পর রাত আঙিনায় তারাদের গতি অনুসরণ করে। সঠিক মধ্যদুপুর বের করার পদ্ধতি আবিষ্কারের
চেষ্টায় আরেকটু হলে তার সর্দি লেগে যেত। যখন সে যন্ত্রগুলো ব্যবহারে পটু হয়ে উঠল, তখন স্থান-কাল সম্বন্ধে তার এমন ধারণা হল যে ঘর থেকে না বেরিয়েই
সে অচেনা সাগরে পথ চলার, মনুষ্যহীন অঞ্চলে ভ্রমণের
আর অসাধারণ সব মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষমতা পেয়ে গেল। এটা ছিল এমন সময় যখন সে বাড়িময় ঘুরে ঘুরে
কাউকে গ্রাহ্য না করে নিজের সঙ্গেই কথা বলত আর এদিকে উরসুলা আর ছেলেরা খেটে যাচ্ছিল
কলা, কচু, মিষ্টি আলু,
কচুর ছড়া, মিষ্টিকুমড়া আর বেগুনক্ষেতে। কোনোরকম পূর্বাভাস
ছাড়াই হঠাৎ করে তার কাজের নেশা বাধাপ্রাপ্ত হল; আর তার বদলে এল এক ধরনের মুগ্ধতা। অনেকদিন কেটে গেল ঘোরে-আক্রান্ত মানুষের মতো নিম্নস্বরে আশ্চর্য
সব ছড়া জপতে জপতে, যেগুলো ছিল তার নিজেরই বোধের অগম্য।
দুই ::
অবশেষে ডিসেম্বরের এক মঙ্গলবার নাস্তার সময়
আচমকা বের করে দিল ওর ভিতরের সমস্ত চিন্তার ঘূর্ণিপাক। বাচ্চারা বাকি জীবন মনে রাখবে কী মহান গাম্ভীর্য
নিয়ে ওদের বাবা টেবিলের মাথায় বসে, জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে
ঘোষণা করে তার দীর্ঘ রাত জাগা আর কল্পনায় আবিষ্কারের কথা: পৃথিবীটা কমলালেবুর মতো গোল।
উরসুলা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। “যদি তুমি পাগল হয়ে
থাক, তাহলে একাই হও” চিৎকার করল,”
কিন্তু তোমার জিপসী চিন্তার সঙ্গে বাচ্চাদের জড়ানোর চেষ্টা করো
না।” ক্রোধের বশে এ্যাস্ট্রোল্যাবটা
মেঝেতে ছুঁড়ে ভেঙে ফেলার পরও নির্বিকার হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া স্ত্রীর ধৈর্যহীনতায়
মোটেই ভড়কে যায় না। সে আরেকটি তৈরি করে নিজের ছোট্ট কামরায় গ্রামের লোকদের জড়ো করে আর তাদের চোখের
সামনে তুলে ধরে অবোধ্য এই সম্ভাবনা যে পুব দিক বরাবর একটানা জাহাজ চালিয়ে গেলে তা আবার
উৎসেই ফিরে আসবে। গায়ের লোকজন যখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার পাগল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত,
তখনই সবকিছু স্বাভাবিক করার জন্য ফিরে আসে মেলকিয়াদেস। বিশুদ্ধ জ্যোতির্বিদ্যক
অনুমান দ্বারা যে এমন এক তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছে যা বাস্তবে প্রমাণিত, যদিও মাকন্দোতে তা ছিল অজানা। তিনি সবার সামনে তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। আর তার মুগ্ধতার নজির
হিসেবে উপহার দেয় তাকে এক আলকিমিয়ার পরীক্ষাগার যা ভবিষ্যতে এ গ্রামের উপর বিশাল প্রভাব
ফেলেছিল।
সেই সময় আশ্চর্য দ্রুততায় বুড়ো হয়ে গিয়েছিল
মেলকিয়াদেস। ওর প্রথম দিককার সফরের সময় মনে হতো সে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ারই বয়সী। দুই কান ধরে একটা ঘোড়াকে
ধরাশায়ী করার মতো প্রবল শক্তিকে হোসে আর্কাদিও নিজের শরীরে ধরে রাখলেও জিপসীটাকে দেখে
মনে হতো নাছোড় রোগে সে কাবু হয়ে গেছে। এ ছিল আসলে পৃথিবীর চারদিকে তার অগণিত ভ্রমণের সময় বিরল সব রোগ
বাধানোর ফল। পরীক্ষাগারটা গড়ে তুলতে সাহায্য করার সময় নিজেই হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিরয়াকে সে
বলছিল যে মৃত্যু ওকে তাড়া করছিল সর্বত্র, শেষ থাবা বসাবার
সিদ্ধান্ত না নিলেও সে তার গন্ধ শুঁকে বেড়িয়েছে ঠিকই। মানবজাতিকে তাড়িয়ে বেড়ানো যতসব মহামারী আর
বিপদ আপদের হাত থেকে ফেরারীর মতো ছিলো সে। পারস্যে পেলাগ্রা রোগ থেকে, মালয় দ্বীপপুঞ্জের স্কার্ভি, আলেকজান্দ্রিয়ার কুষ্ঠ,
জাপানের বেরিবেরি, মাদাগাস্কারের
বুবনিক প্লেগ, সিসিলির ভূমিকম্প আর ম্যাগিলান প্রণালীর জাহাজডুবী
থেকে বেঁচে গিয়েছিলো সে। নস্ত্রাদামুর মূল রহস্যগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বলে কথিত এই
অদ্ভুত লোকটি বিষাদগ্রস্ত, বিষন্নতার বলয়ে ঢাকা,
আর চেহারা-সুরত ছিল এশীয় ধরনের, যাকে দেখলে মনে হতো যেন ঘটনার অজানা দিকগুলোও তার জানা। কাকের ডানার মতো বিস্তৃত কালো রংয়ের এক বিশাল
টুপি পড়তো সে, আর গায়ে চড়ানো থাকতো শতাব্দীর সবুজ,
উজ্জল এক মখমলের কুর্তা। বিপুল জ্ঞান আর রহস্যময় ব্যাপ্তি সত্ত্বেও
তার মধ্যে এক মানবিক দায়ভার ছিলো, এক পার্থিব দশার কারণে
দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো সমস্যাগুলো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে রাখতো। অনুযোগ করত বয়সজনিত
ব্যথা নিয়ে, ভুগত একেবারেই গুরুত্বহীন আর্থিক নানান ঝামেলায়,
স্কার্ভির কারণে দাঁতগুলো পড়ে যাওয়ায় হাসা বন্ধ করে দিয়েছিল
সে অনেক আগেই। সেই রুদ্ধশ্বাস দুপুরে যখন সমস্ত গোপন কথা ফাঁস করছিল সে, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তখন নিশ্চিত হলো যে, সেই সময়টাই ছিলো মহান বন্ধুত্বের সূচনা। শিশুরা চমৎকৃত হতো
তার উদ্ভট গল্প শুনে। আউরেলিয়ানোর বয়স তখন পাঁচের বেশী হবে না। সেই আউরেলিয়ানো পরবর্তী জীবনে সেই বিকেলে
লোকটাকে যেভাবে দেখেছে তার সবকিছু মনে রাখবে। জানালা থেকে আসা ধাতব শব্দ আর মৃদু আলোর বিপরীতে
বসে তার গলা থেকে উঠে আসা প্রগাঢ় শব্দ দিয়ে উজ্জল করছে কল্পনার সবচেয়ে কালো অঞ্চলগুলোকে;
ততক্ষণে তার কপালের দুই রগ বেয়ে পড়ছে গরমে গলে-পড়া চর্বি। ওর বড় ভাই হোসে আর্কাদিও,
সেই বিস্ময়কর প্রতিমাকে এক বংশানুক্রমিক স্মৃতি হিসেবে তুলে
দিয়ে যাবে তার সমস্ত উত্তরপুরুষের হাতে। অন্যদিকে, উরসুলা সেবারের সফরের
মন্দ স্মৃতিটাই মনে রেখেছে; কারণ, সে ঘরে ঢোকার সময় মেলকিয়াদেস বেখেয়ালে পারদের একটা গ্লাস ভেঙে
ফেলে।
——————————-
আর্হেন্তিনার বুয়েনোস আইরেস-এর
এদিতোরিয়াল সুদামেরিকানা প্রকাশনী থেকে
প্রকাশিত ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাসের
প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ
——————————-
এতো শয়তানের গন্ধ, বলল উরসুলা।
একদমই নয়, শুধরে দিয়ে মেলকিয়াদেস বলে, সবাই জানে শয়তানের
মধ্যে রয়েছে গন্ধকের গুণ আর এটাতো সামান্য এক ক্ষয়কারী পদার্থ ছাড়া বেশি কিছু নয়।
সার্বক্ষনণক নীতিবাগীশ মেলকিয়াদেস সিঁদুর
বর্ণের পদার্থের নারকীয় গুণ সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে বসে, কিন্তু উরসুলা তাতে কান দিল না, বরঞ্চ বাচ্চাদের নিয়ে গেল প্রার্থনায়। ঐ কামড় বসানো গন্ধ মেলকিয়াদেসের স্মৃতির সঙ্গে এক হয়ে সবসময়
তার মনে বসে থাকবে।
অসম্পূর্ণ পরীক্ষাগারে বাসন কোসন,
ফানেল. বকযন্ত্র, ফিল্টার ও ছাঁকনির
কথা বাদ দিলেও তাতে ছিলো সরু গলাওয়ালা এক লম্বা কাচের টেস্টটিউব, এক নকল পরশ পাথর, আর মারিয়া দে
হুদিয়ার সর্বাধুনিক সূত্রানুযায়ী জিপসীদের নিজ হাতে বানানো এক তে-হাতা পাতন যন্ত্র। এছাড়াও মেলকিয়াদেস
রেখে গেল সাত গ্রহের সঙ্গে সম্পর্কিত সাতটি ধাতুর নমুনা, আর সোনা দ্বিগুণ করার জন্য মুসা ও জোসিমার সূত্রাবলী। আর পরশ পাথর বানাতে আগ্রহী কেউ যাতে এ-সবের
অর্থোদ্ধার করতে পারে সেজন্য মহতী শিক্ষার পদ্ধতি বিষয়ে একগুচ্ছ টীকাটিপ্পনী ও নকশা।
সোনার পরিমান দ্বিগুণ করার প্রক্রিয়ার সহজতায়
প্রলুব্ধ হয়ে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া কয়েক সপ্তাহ যাবত ধরনা দেয় উরসুলার কাছে ঔপনিবেশিক
আমলের স্বর্ণ মুদ্রাগুলো মাটি খুঁড়ে তোলার জন্য, যাতে করে সে সোনার পরিমাণ ইচ্ছেমতো বাড়াতে পারে। সবসময়ের মতো এবারও উরসুলা হার মানল স্বামীর
ক্রমাগত তাগাদার কাছে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তিরিশটি স্বর্ণমুদ্রা, তামার গুড়ো, হরিতাল, গন্ধক আর সীশে এক কড়াইতে রেখে গলিয়ে ফেলে। ওগুলোকে এরপর এক পাত্র রেড়ির তেলে গনগনে আগুনে
জ্বাল দিতে থাকে, যতক্ষণ না সেটা এক ঘন তরল পদার্থে পরিণত হয়,
যা দেখতে সোনার উজ্জ্বলতার চেয়ে বরং কদর্য মিষ্টি গাদের মত। এই ঝুঁকিবহুল আর অসহিষ্ণু
পাতনের পদ্ধতির কারণে নির্বিকার পারদ, গ্রহযুক্ত সপ্ত
ধাতু, সাইপ্রাসের কাঁচ মূলোর তেলের অভাবে আর একবার
শুয়োরের তেলে রন্ধনের ফলে উরসুলার মূল্যবান উত্তরাধিকার পরিণত হয় কয়লা হয়ে-যাওয়া শুয়োরের
চামড়ার মত এক পদার্থে, যা নাকি পাত্রের তলা
থেকে আর আলাদা করা যায় না।
যখন জিপসীরা ফিরে আসে, তখন উরসুলা গ্রামের সমস্ত লোকজনকে ওদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে রাখে
। কিন্তু ভয়ের চেয়ে কৌতূহলই
জয়ী হলো। কারণ সেবার যখন জিপসীরা সব রকম বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কানের পর্দা-ফাটানো আওয়াজ তুলে
সারা গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন ঘোষক এসে জিপসীদের
আবিষ্কৃত সবচেয়ে চমৎকার বস্তু প্রদর্শনের ঘোষণা দিয়েছিলো।
(চলবে)
তিন ::
যাতে করে পৃথিবীর সবাই চলে যায় তাঁবুতে,
আর এক সেন্টের বিনিময়ে দেখতে পায় বলিরেখাহীন, নতুন ঝকমকে দাঁতসহ এক যুবক মেলকিয়াদেসকে। স্কার্ভিতে ক্ষয়ে যাওয়া
দাঁত, তোবরানো গাল আর চুপসে যাওয়া ঠোঁটের কথা যাদের
মনে ছিল ভয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় তারা জিপসীর অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা দেখে। এই ভয় আতংকে পরিণত
হয় যখন মেলকিয়াদেস তার মাড়ি সংলগ্ন অক্ষয় দাঁতগুলোকে বের করে দর্শকদের দেখায় মুহুর্তের
জন্য–আর তাৎক্ষনিকভাবে সে রূপান্তারিত হয় আগের বছরগুলোতে দেখা একই
লোকে। ওগুলোকে সে আবার লাগিয়ে
যৌবনকে ফিরিয়ে এনে নতুন করে কর্তৃত্বময় হাসি আসে। স্বয়ং হোসে আর্কাদিও বুয়েনদিয়া মনে করে মেলকিয়াদেসের
জ্ঞান অসহ্য রকমের চরম অবস্থায় পৌঁছে গেছে, কিন্তু যখন জিপসী লোকটা তার সঙ্গে একাকী নকল দাঁতের কারিগরি খুলে বলে তখন অনুভব
করে এক পরিপূর্ণ প্রসন্নতা। এটা তার কাছে একই সঙ্গে এতই সহজ আবার জ্ঞানময় মনে হয় যে আলকেমি
নিয়ে গবেষণা করার সমস্ত আকর্ষণ তার রাতারাতি উবে যায়; নতুন করে সে ভোগে বদমেজাজে, আর সময় মত না খেয়ে
সাড়া বাড়িময় ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটায়। “পৃথিবীতে অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটে চলছে” বলে উরসুলাকে, “ঐখানে,
নদীর অপর পাড়ে আছে সব রকমের যাদুকরী যন্ত্রপাতি আর আমরা কিনা
দিন কাটাচ্ছি গাধার মত”। যারা ওকে মাকোন্দোর পত্তনের সময় থেকে চিনত তারা আশ্চর্য হতো
এটা দেখে যে মেলকিয়াদেসের প্রভাবে সে কতই না বদলে গেছে।
প্রথম দিকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ছিল
তরুণ গোত্রপতি ধাঁচের, যে চাষাবাসের শিক্ষা
দিত, বাচ্চাকাচ্চা আর জীবজন্তু লালন পালনের উপদেশ দিত, সর্বক্ষেত্রেই সাহায্য করত–এমনকি শারিরীক ভাবেও —গোত্রের অগ্রগতির জন্য। যেহেতু প্রথম থেকেই
তার বাড়িটা ছিল গাঁয়ের সেরা, তাই অন্য বাড়িগুলোও
তৈরি হয়েছিল তারই আদলে এবং একই রকমে। বসার ঘরটা ছিল বেশ বড় এবং আলোময়, উঠোনের মত খাবার ঘর আনন্দময় রংয়ের ফুল দিয়ে সাজানো, দুটো শোবার ঘর, বিশাল চেষ্টনাট গাছসহ এক উঠোন, সাজানো ফলমূলের বাগান আর শান্তিতে এক সঙ্গে বসবাসরত ছাগল,
শুয়োর আর মুরগীর খোয়াড়। শুধু তার বাড়িতেই নয়, সমস্ত গ্রামেই, যেটা এক মাত্র
নিষিদ্ধ প্রাণী ছিল, সেটা হলো লড়াইয়ের মোরগ।
স্বামীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করার ক্ষমতা
ছিল উরসুলার। কর্মঠ, ছোটখাটো, কঠোর, যে মেয়েটা ছিল অবিনাশী স্নায়ুশক্তির অধিকারী,
জীবনে কেউ তাকে গান গাইতে শোনেনি, তার উপস্থিতি ছিল সব সময় ডাচ্ লিনেনের স্কার্টের মৃদ্যু খসখসানীসহ সকাল থেকে রাত
পর্যন্ত। পেটানো মাটির মেঝে, চুনকালিবিহীন কাদার
দেয়াল, নিজেদের তৈরি করা সাদামাটা আসবাবপত্র ছিল
সব সময় পরিস্কার। আর যে পুরোনো সিন্ধুকে কাপড়চোপড় রাখা ছিলো, সেখান থেকে বের হতো তুলসী পাতার মৃদু গন্ধ।
হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ছিল গায়ের সবচেয়ে
উদ্যমী লোক, ওরকম উদ্যামী লোক গ্রামে আর কখনই দেখা যাবে
না। বাড়িগুলোকে সে এমনভাবে
বসিয়েছিল যে সব বাড়ি থেকেই নদীতে আসতে পারত সবাই এবং পানি নিতে পারত একই পরিশ্রমে। রাস্তাগুলোকে সে এমনভাবে
সারি করেছিল যাতে গরমের সময় কোন বাড়িই একটার চেয়ে অপরটা বেশী রোদ না পায়। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে,
তিন শ’ অধিবাসীর মাকন্দো ছিল
যে কোন চেনাজানা গ্রামের চেয়ে অনেক বেশি সাজানো এবং শ্রমসাধ্য। সত্যিকার অর্থে ছিল
এক সুখী গ্রাম। যেখানে কারোর বয়স তিরিশের বেশী ছিল না এবং কেউ মারা যায়নি।
বসতি স্থাপনের সময় থেকেই হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া
বানাতো ফাঁদ আর খাঁচা। অচিরেই সে টুর্পিয়াল, ক্যানারি, আসুলেহোস আর পেতিররোহোস পাখি দিয়ে শুধু নিজের বাড়িই নয়,
পুরো গ্রামটাই ভরে ফেললো। এতসব পাখির সমবেত গান এতই হতবুদ্ধিরকর হয়ে
ওঠে যে উরসুলা মোম দিয়ে কান বন্ধ করে রাখতো যাতে সে বাস্তববোধ হারিয়ে না ফেলে। মেলকিয়াদেসের গোষ্ঠিটা
যখন প্রথমবার এসে মাথাব্যাথা সারানোর কাঁচের গুলি বিক্রি করলো তখন সবাই অবাক হয়েছিল
যে কি করে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন জলাভূমিতে হারিয়ে যাওয়া এই গ্রামটাকে ওরা খুঁজে পেয়েছে
আর জিপসীরা জানালো যে পাখীর কলতান শুনেই তারা দিক খুঁজে পেয়েছে।
তার সেই সামাজিক উদ্দীপনা অল্প সময়ের মধ্যেই
উবে যায় চুম্বকের মোহ, জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত
হিসাব-নিকাশ, পদার্থ রূপান্তরের স্বপ্ন, আর বিশ্বের অত্যাশ্চর্যকে জানার তাড়নায়। উদ্যমী আর পরিচ্ছন্ন
এক লোক থেকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া পরিণত হয় এক অলস, পোশাকে অমোনযোগী, আর এমনই বুনো দাড়িওয়ালা এক লোকে যে দাড়িগুলো
উরসুলা রান্না ঘরের ছুরি দিয়ে অতি কষ্টে একটা আকার দিয়ে দেয়। এমন কেউ ছিল না যে তাকে আজব কোন যাদুমন্ত্রের
শিকার বলে মনে করতো না। তার পাগলামির ব্যাপারে সুনিশ্চিত লোকজন পর্যন্ত কাজ আর সংসার ছেড়ে দিয়ে তাকে অনুসরন
করে। সে কাঁধে তুলে নিল
তার বিশ্লেষণ করার যন্ত্রপাতিগুলো এবং যোগ দিতে বলল সবাইকে এক রাস্তা খোলার জন্য যা
নাকি মাকন্দোকে সংযুক্ত করে দেবে বড় সব আবিস্কারের সঙ্গে।
ঐ এলাকার ভৌগলিক অবস্থান সম্বন্ধে হোসে আর্কাদিও
বুয়েন্দিয়া ছিল পুরোপুরি অজ্ঞ। জানতো যে পূব দিকে ছিল এক দুর্গম পর্বতমালা, আর পর্বতমালার অপর দিকে প্রাচীন শহর রিয়োহাচা, যেখানে, ওর দাদা প্রথম আউরেলিয়ানো
বুয়েন্দিয়ার ভাষ্যমতে, প্রাচীনকালে স্যার
ফ্রান্সিস ড্রেক বিশাল কুমীর শিকার করেছিল কামান দেগে বিনোদনের জন্য আর পরে ক্ষতস্থান
জোড়া দিয়ে ওতে খড় ভরা হতো রাণী ইসাবেলের কাছে নেয়ার জন্য। যৌবনে, সে এবং সমস্ত পুরুষ, মহিলা, বাচ্চাকাচ্চা, পশু আর ঘরোয়া
জিনিসপত্রসহ পর্বত পাড়ি দিয়েছিল সাগরে যাওয়ার পথ খুঁজতে এবং ছাব্বিশ মাস পর সে চেষ্টায়
ক্ষান্তি দিয়ে মাকন্দোয় পত্তনি গড়ে তোলে যাতে করে আবার ফেরার রাস্তা পাড়ি দিতে না হয়। ওটা ছিল এমন এক রাস্তা
যাতে তার কোন আগ্রহ ছিল না, কারণ ওটা নিয়ে যেতে
পারতো কেবল অতীতের দিকে। দক্ষিণে ছিল সীমাহীন জলজ উদ্ভিদে ঢাকা জলাভূমি আর জিপসীদের কথানুযায়ী
এই বিশাল জলাভূমির বিপুল বিশ্বের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। ভুল করে মনে হতো বিশাল পশ্চিমের জলভূমিটা
দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত, যেখানে ছিল নারীর শরীর,
মাথা, আর কোমল চামড়াসহ তিমিজাতীয়
প্রাণী যাদের বিশাল স্তনের মোহে পড়ে নাবিকরা দিক হারাতো। জিপসীরা ছয় মাস এই পথ ধরে নৌচালনা করে এক
ফালি শক্ত জমিতে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত, যেখান দিয়ে
ডাক-বওয়া খচ্চরগুলো চলাচল করে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার হিসাব মতে সভ্যজগতের সংস্পর্শে আসার
একমাত্র সম্ভাব্য রাস্তা ছিল উত্তরে। সুতরাং সে জঙ্গল কাটার ও শিকারের যন্ত্রপাতি তুলে দেয় তাদের
হাতে যারা মাকন্দোর স্থাপনার সময় থেকে তার সঙ্গী। একটা থলির মধ্যে নির্দেশনার যন্ত্র আর মানচিত্রগুলো
ভরে আরম্ভ হলো সেই দুঃসাহসী অভিযাত্রা।
প্রথম কয়েকদিন উল্লেখযোগ্য কোন বাঁধাই তারা
পেল না। নদীর পাথুরে তীর ধরে নীচে নামতে নামতে চলে আসে তারা সেই জায়গায় যেখানে অনেক বছর
আগে পাওয়া গিয়েছিল এক সৈনিকের বর্ম আর সেখানেই প্রবেশ করে বুনো কমলাবনের ভেতর এক পথ
ধরে। প্রথম সপ্তাহ শেষ হওয়ার
পর এক হরিণ শিকার করে আগুনে ঝলসায় তারা কিন্তু সন্তুষ্ট হয় শুধুমাত্র অর্ধেকটা খেয়ে
বাকি অর্ধেক নুন মাখিয়ে ভবিষ্যতের দিনগুলোর জন্য রেখে দেয়। একই সতকর্তার কারণে বড় টিয়া পাখি খাওয়ার ধারণাটাও
তারা বাদ দেয় যার নীল মাংশ ছিল আঁশটে আর সুগন্ধিময়। দশদিন ধরে তারা সূর্যের মুখ দেখতে পেল না। আগ্নেয়গিরির ছাইয়ের
মতো মাটি হয়ে এলো নরম আর স্যাঁতসেতে। বনজঙ্গল ক্রমাগত আরও বেশি প্রতারণাময় হয়ে উঠেছিলো, আর পাখির কলরব আর বানরের কোলাহলকে আরও দূরের মনে হচ্ছিলো। আর পৃথিবী চিরকালের
জন্য হয়ে উঠল আরও বিষাদগ্রস্থ।
অভিযাত্রীরা ওদের আদি পাপেরও আগের,
আদিতম স্মৃতির তাড়নায় সেই স্যাঁতসেতে স্বর্গে আর নির্জনতায় ডুবে
যায় যেখানে জুতা দেবে যায় ধোয়াটে তেলের গর্তে আর দাগুলো ধ্বংস করে রক্তিম লিলিফুল আর
সোনালি সালামান্দার।
এক সপ্তাহ ধরে প্রায় কথাবার্তা ছাড়া নিশাচরের
মত, দমবন্ধ করা রক্তের গন্ধে ফুসফুস ভর্তি করে অগ্রসর হলো এক শোকাবহ
বিশ্বের মধ্য দিয়ে যা কেবল আলোকিত হয়ে আছে আলোকদায়ী পোকামাকড় দ্বারা। ওরা আর ফিরতে পারত
না কারন যে পথ তৈরি হয়েছিল অল্পক্ষণের মধ্যেই তা বন্ধ হয়ে আসছিল নতুন গাছপালায়,
যেন এই মাত্র সেগুলো বেড়ে উঠছিল ওদের চোখের সামনে। “কিছু আসে যায় না,”
বলতো হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, “আসল কথা হচ্ছে দিক না হারানো”। সেই ভুতগ্রস্ত এলাকা থেকে বেরিয়ে আসার আগ পর্যন্ত সারাক্ষণ কম্পাসের
দিকে লক্ষ রেখে পথ দেখিয়ে যাচ্ছিলো ওর লোকদের অদৃশ্য উত্তরের দিকে। সেটা ছিল নক্ষত্রবিহীন
এক ঘন রাত কিন্তু অন্ধকার ভরা ছিল নতুন আর নির্মল বাতাসে। দীর্ঘ পথযাত্রায় অবসন্ন হয়ে ওরা হ্যামকে গভীর
ঘুমে কাটিয়েছিলো দুই সপ্তাহ প্রথমবারের মত। যখন জেগে উঠল বিম্ময়ে আপ্লুত হয়ে গেল তারা, সূর্য তখনও মাথার উপরে। ওদের সামনে, তাল গাছ আর ফার্ন। সকালের শুভ্র সুক্ষ্ণকণার আলোয় বেষ্টিত নিঃস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল জাহাজ। ডান দিকে সামান্য কাত
হয়ে থাকা জাহাজের অক্ষত মাস্তল থেকে ঝুলছিল দুভাগ হয়ে যাওয়া, দুর্বল, আকিও ফুলাংকিত পালের
অংশ। পাথুরে মাটিতে শক্তভাবে
গেথে থাকা খোলটি ঢাকা রয়েছে শিলীভূত উজ্জ্বল শামুক আর নরম শৈবালে। নিঃসঙ্গতা আর বিস্মৃতির
জায়গা নিয়ে সমস্ত কাঠামোটা যেন দখল করে আছে এক নিজস্ব ব্যাপ্তি যা সময়ের কলুষ আর পাখপাখালির
আচার আচরণে দুর্ভেদ্য। জাহাজের ভেতরে অভিযাত্রীরা গোপন উদ্দীপনায় যা খুঁজে পেল তা ফুলের এক নিবিড় বন ছাড়া
বেশি কিছু না।
ধারে কাছেই সমুদ্র থাকার ইঙ্গিত বহনকারী এই
জাহাজ আবিস্কার হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার সমস্ত উৎসাহ ভেঙে দেয়। প্রচন্ড আত্মত্যাগ
আর খেসারত দিয়ে খুঁজে না পেয়ে আর না-খুঁজেই রাস্তার মাঝখানে এক অমোঘ বাধা স্বরূপ সমুদ্রকে
দেখতে পেয়ে নিজের দুষ্ট নিয়তিকে এক বিদ্রুপের মত মনে হয় তার কাছে। অনেক বছর পর কর্ণেল
আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া আবার যখন এই জায়গাটা অতিক্রম করে তখন তা হয়ে গিয়েছিলো ডাক চলাচলের
এক নিয়মিত রাস্তা আর জাহাজের একমাত্র যে জিনিসটা দেখতে পেয়েছিল তা হলো আফিম খেতের মাঝে
এর পোড়া কাঠামোটা। আর তখনই সে নিশ্চিত হয় যে ওটা তার বাবার খামখেয়ালী কল্পনায় সৃষ্ট কোন গল্প নয়,
আর নিজেই নিজেকে সে প্রশ্ন করে কিভাবে জাহাজটা কঠিন মাটিতে এতখানি
ঢুকে গিয়েছে। কিন্তু আরও চারদিন ভ্রমণের পর জাহাজ থেকে সমুদ্রকে যখন বারো কিলোমিটার দূরত্বে
পেল তখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া এ নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করল না। তার এত আত্মত্যাগ আর
ঝুঁকিপূর্ণ এই অভিযানের, স্বপ্নের শেষ হলো এই
ফেনিল, নোংরা, ছাইরঙা সমুদ্রের সামনে যা তার প্রাপ্য নয়।
চার ::
সর্বনাশ–চিৎকার করল সে– মাকন্দোর চারদিক পানিতে ঘিরে আছে।
অভিযান থেকে ফিরে এসে মানচিত্রে যুক্তিহীনভাবে
হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার আঁকা মাকন্দো উপদ্বীপের ধারণাটি অনেকদিন পর্যন্ত টিকে ছিল। রেখাগুলো এঁকেছিল প্রচন্ড
রাগে, যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতাকে অতিরঞ্জিত করে,
যেন চরম বুদ্ধিহীনভাবে জায়গাটা বেছে নেবার জন্য নিজেকে শাস্তি
দেবার জন্য। “কখনই পৌঁছুতে পারব না কোথায়ও,” খেদ প্রকাশ
করে সে উরসুলার কাছে, “ বিজ্ঞানের সুবিধাগুলো
না পেয়ে এখানেই আমাদের জীবন পচতে থাকবে”। ছোট্ট গবেষণাগারে কয়েক মাসের উপর্যুপরি চিন্তার ফলপ্রসূ এই নিশ্চয়তা
মাকন্দোকে আরও উপযুক্ত এক অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণে তাকে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু এইবার,
উরসুলা তার এই অস্থির পরিকল্পানার কথা আগেই আঁচ করে ফেলে। এরই মধ্যে স্থানান্তরের
জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করা পুরুষদের হুজুগের বিরুদ্ধে গোপন ও পিপড়ার মতো ক্ষান্তিহীন
এক পরিশ্রমে গ্রামের নারীদের সে উপযোগী করে তোলে।
পুরো ব্যাপারটি একেবারে বিশুদ্ধ আর সাধারণ
একটা মরিচীকায় রূপান্তরিত হ্ওয়ার আগ পর্যন্ত হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বুঝতেই পারলো
না কখন, এমনকি কোন প্রতিকূল শক্তির গুণে তার পরিকল্পনাগুলো
নানান সব অজুহাত, বিপত্তি ও ওজরের বিশৃঙ্খলার মধ্যে জড়িয়ে পড়লো।
উরসুলা তাকে নিষ্পাপ মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলো,
এমনকি ওর প্রতি একটু দয়াও বোধ হলো। গবেষণাগারের জিনিষগুলোকে তাদের মূল বাক্সের
ভেতর যখন গুছিয়ে রাখছিলো তখন ওকে কোনার ছোট্ট ঘড়টিতে স্থান পরিবর্তনের স্বপ্নের কথা
বিড়বিড় করে বলতে শুনা গেল । উরসুলা ওকে কাজগুলো শেষ করতে দিল। বাক্সগুলোতে পেরেক ঠোকা, আর ঝর্না কলম দিয়ে বাক্সের গায়ে নামের আদ্যাক্ষর লিখাও শেষ করতে
দিল কোনরকম গঞ্জনা ছাড়াই, যদিও উরসুলা জানতো
যে ও জেনে গেছে (কারণ সে শুনতে পেয়েছিলো ওর বধির স্বগতোক্তি) গ্রামের পুরুষরা তার এই
উদ্যোগে সঙ্গী হবে না। কেবল ঘরের দরজাটা যখন তুলতে যাচ্ছে তখনই শুধু উরসুলা সাহস করল জিজ্ঞেস করে কেন
সে খুলছে, আর তার জবাবটা সে দিলো তিক্ততার সঙ্গে “যেহেতু কেউ যেতে চায় না, আমরা একাই যাব”, উরসুলা এতে বিচলিত হলো না।
- আমরা যাব না– বলল সে- আমরা এখানেই থেকে যাব, কারণ এখানেই আমার এক
ছেলেকে পেয়েছি।
- এখনও পর্যন্ত কেউ মরেও নি - সে বলল–
মাটির তলায় না যাওয়া পর্যন্ত কেউ-ই কোনো জায়গার নয়।
উরসুলা এক কোমল দৃঢ়তায় জবাব দিল - এখানে থেকে
যাওয়ার জন্য যদি আমাকে মরতে হয় তবে আমি মরব।
হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বিশ্বাস করে উঠতে
পারল না তার বৌয়ের ইচ্ছে শক্তি এতটা দৃঢ় হতে পারে। চেষ্টা করল তার যাদুময়ী আজগুবি কল্পনা আর
বিস্ময়কর এক পৃথিবীর অঙ্গীকার দিয়ে ওকে প্রলুব্ধ করতে যেখানে মাটিতে যাদুকরী তরল পদার্থ
ছিটালেই গাছ হয় মানুষের ইচ্ছানুযায়ী, যেখানে বিক্রি
হয় খুব সস্তায় ব্যাথা সারানোর সব যন্ত্রপাতি। কিন্তু উরসুল ছিল নিরাসক্ত ওর দূরদৃষ্টিতে।
- এই সব আজগুবী চিন্তার চেয়ে বরং তোমার সন্তানদের
দায়িত্ব নেয়া উচিৎ– উত্তর দিল- দেখ ওদের কী অবস্থা, যেন আল্লার ওয়াস্তে ঘুরে বেড়ানো গাধা। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া আক্ষরিক অর্থেই
বৌয়ের কথাগুলো ধরে নিল। জানলা দিয়ে তাকিয়ে রৌদ্রতপ্ত বাগানে দুই ছেলেকে খালি পায়ে দেখতে পেল, ঐ মূহুর্তে ওর মনে হলো কেবল উরসুলার যাদুবলে যেন ওদের অস্তিত্বের
শুরু হয়েছে। কিছু একটু ঘটে গেল তার ভিতরে, রহস্যময় এবং সুনির্দিষ্ট
এমন একটা ব্যাপার যা তাকে সত্যিকারের সময় থেকে উপরে ফেলে নিয়ে যায় স্মৃতির এক অনাবিস্কৃত
অঞ্চলে। উরসুলা যখন এ জীবনে গ্রাম ছেড়ে না যাবার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিল
তখন সে মগ্নতা নিয়ে বাচ্চাদের দেখতে থাকে চোখগুলো ছলছল হ্ওয়া পর্যন্ত। হাত দিয়ে দুচোখ মুছে
হাল ছেড়ে দেয়ার এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।
- বেশ - বলল - ওদের বল যাতে আমাকে বাক্স থেকে
জিনিষগুলো বের করতে সাহায্য করে।
বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়, হোসে আর্কাদিওর চৌদ্দ বছর পূরণ হয়েছে। ওর ছিল চৌকোমাথা, মাথা ভর্তি চুল আর চরিত্র ছিল বাপের মতই স্বেচ্ছাচারী। শারীরিক বৃদ্ধি আর শক্তিমত্তা একই রকম হলেও
তখন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে ওর ছিল কল্পনাশক্তির কিছু অভাব। ও পেটে আসে এবং জন্ম গ্রহণ করে মাকন্দো পত্তনের
আগে কষ্টকর পর্বতসংকুল পাড়ি দেবার সময়, বাবা-মা খোদাকে
ধন্যবাদ জানায় ওর শরীরে কোন জন্তুর অঙ্গ ছিল না বলে। আউরেলিয়ানো ছিল মাকন্দোতে জন্মানো প্রথম মানবসন্তান,
মার্চে ছয় বৎসর পূরণ হবে। স্বভাবে সে নীরব এবং মনোযোগী। মায়ের পেটে থাকতে কান্নাকাটি
করত আর জন্মেছিল চোখ খোলা অবস্থায়। যখন ওর নাড়ি কাটা হচ্ছিল তখন ঘরের জিনিষপত্র চিনতে চিনতে সে
মাথা নাড়ছিল এদিক ওদিক। লোকজনের চেহারা পরীক্ষা করছিল এক বিস্ময়হীন কৌতুহল নিয়ে। পরে, যারা ওকে দেখতে এসেছিল তাদের দিকে গুরুত্ব না-দিয়ে সমস্ত মনযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিল
তালের পাতায় ছাওয়া ছাদটার দিকে যেটা প্রচন্ড বৃষ্টির চাপে প্রায় ভেঙ্গে পরার উপক্রম। ওর দৃষ্টিপাতের এই
তীব্রতার কখা আর মনে পড়েনি। মনে পড়লো যেদিন সে জলন্ত উনুনে বলক দিতে থাকা স্যুপের পাতিল
সরিয়ে টেবিলে রাখছিল সেই মুহূর্তে তিন বছরের ছোট্ট আউরেলিয়ানে ঘরে এসে হাজির । দরজায় দাড়ানো কিংকর্তব্যবিমুঢ়
শিশুটি বলল ‘‘ওটাতো পড়ে যাবে”-। পাতিলটা টেবিলের মাঝখানে ভালভাবেই রাখা ছিল,
কিন্তু শিশুর ঘোষণামাত্র , যেন অভ্যন্তরিন এক গতির দ্বারা চালিত হয়ে টেবিলের কিনারে চলে আসে সেটি আর মেঝেতে
পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ভীত উরসুলা ঘটনাটা স্বামীকে জানায়, কিন্তু সে এটাকে এক প্রাকৃতিক কোনো ব্যাপার বলে ব্যাখ্যা করে। বাচ্চাদের অস্তিত্বে
উদাসীন হোসে আর্কাদিও কিছুটা এরকমই ছিলো সবসময়, এমন থাকার কারণ শৈশবকে সে মানসিক অপর্যাপ্ততা বলেই মনে করতো আর অন্যদিকে নিজের
অবাস্তব কল্পনায় তন্ময় থাকাটাও ছিলো আরেকটা কারণ।
কিন্তু সেই বিকেলের পর থেকে, যেদিন সে বাচ্চাদের ডাকলো বাক্স থেকে জিনিসপত্রগুলো বের করতে
সাহায্যের জন্য তখন থেকেই বেশীর ভাগ সময় সে ওদের পিছনে উৎসর্গ করতে লাগলো। মূল বাড়ি থেকে একটু
দূরের সেই কামরাটার দেয়াল ভরে উঠছিল ধীরে ধীরে অবিশ্যাস্য মানচিত্র, আর অলীক সব গ্রাফে, সেখানে ওদের
শেখাল পড়তে, লিখতে, গুনতে, সর্বোপরি শেখাল পৃথিবীর বিস্ময়গুলো সম্পর্কে
যা কেবল ওর জানা জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না বরং সেগুলো ওর অবিশ্বাস্য কল্পনার শেষ
সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো । এভাবেই শিশুরা শেখে আফ্রিকার একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে এমন সব
বুদ্ধিমান আর শান্তিপ্রিয় মানুষ আছে যাদের বিনোদন হচ্ছে শুধুমাত্র বসে বসে ভাবা অথবা
এক দ্বীপ থেকে অন্যদ্বীপে লাফ দিয়ে পার হওয়ার মাধ্যমে ইজিয়ান সাগর পাড়ি দেয়া সম্ভব
সালোনিক বন্দর পর্যন্ত । সেই সমস্ত ঘোরলাগা বৈঠকগুলো শিশুদের মনের মধ্য এমনভাবে গেঁথে
যায় যে, বহু বছর পর পদাতিক বাহিনীর অফিসার ফায়ারিং
স্কোয়াডকে গুলি ছোড়ার আদেশের এক মূর্হতে আগে, কর্ণেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া চলে গেল মার্চের সেই নরম বিকেলে যখন ওর বাবা পদার্থবিদ্যায়
বিরতি দিয়ে, স্থির চোখে, বাতাসে হাত তুলে মুগ্ধ হয়ে দাড়িয়ে শুনছিল দূর থেকে আসা বাঁশী, ঢোল আর খরতালের জিপসীদের আরও একবার গাঁয়ে আসার শব্দ,
আর ঘোষণা করছে মেমফিসের বিজ্ঞ লোকদের আশ্চর্যকর সর্বশেষ আবিস্কারের
কথা। এরা ছিল নতুন জিপসী
দল। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ
ও মহিলার দল শুধু মাত্র কথা বলতে পারে নিজেদের ভাষায়। তেলতেলে চামড়া আর বুদ্ধিদীপ্ত হাতের আদর্শ
সৌন্দর্যের পুরুষগুলো নাচ আর গান দিয়ে রাস্তায় বপন করেছিলো এক আনন্দময় হট্টগোলের আতংক। এদের সঙ্গে ছিলো ইটালিয়
গাথাকাব্য আওড়াতে সক্ষম বহুবর্ণে রাঙানো টিয়া পাখী, তামবোরিনের আ্ওয়াজে শতেক সোনার ডিমপ্রসবী মুরগী, মানুষের চিন্তা আঁচ করতে পারা এক প্রশিক্ষিত বাঁদর, একাধিক কাজে সক্ষম যন্ত্র যা দিয়ে বোতাম শেলাই ও জ্বর নামানো যায়, খারাপ স্মৃতি ভুলে যাবার যন্ত্র, সময় ভুলে যাবার বড়ি। আরও হাজারটা আবিষ্কার, যা এতই উৎভাবনশক্তিসম্পন্ন আর অসাধরণ যে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার খুব ভালো লাগতো
যদি ওগুলো মনে রাখার একটা যন্ত্র আবিস্কার করতে পারতো। মূহুর্তের মধ্যে গ্রামটা বদলে যায়। মাকন্দোবাসীরা হারিয়ে
যায় ওদের নিজেদেরই রাস্তায়, মেলার ভীড়ে বিহবল হয়ে।
বিশৃংখলার মধ্যে যাতে না হারিয়ে যায়,
তাই দুই হাতে দুই ছেলেকে ধরে সোনার দাঁতের কসরৎকারী আর ছয় বাহুর
ভেল্কিবাজ, মল আর চন্দন কাঠের দমবন্ধ করা গন্ধের ভিতর,
হোঁচট খেতে খেতে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া পাগলের মত সর্বত্র
খুঁজছিল মেলকিয়াদেসকে, যাতে করে সে অবিশ্যাস্য
দুঃস্বপ্নের গোপন কথাগুলো ব্যাখা দিতে পারে। অনেক জিপসীর কাছেই সে গেল কিন্তু কেউ-ই তার ভাষা বুঝতে পারলো
না।
অবশেষে সেই জায়গায় সে এলো যেখানে মেলকিয়াদেস
তাঁবু গাড়তো আর পেলো এক মৃদুভাষী আর্মেনিয়কে যে কিনা স্প্যানিশ ভাষায় ঘোষণা করছে অদৃশ্য
হওয়ার গুনসম্পন্ন এক সিরাপের কথা। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া দর্শকদের ভীর ঠেলে যখন ওকে প্রশ্ন
করতে পারল তখন লোকটা এক ঢোকে পীতাভ রংয়ের এক পদার্থ কেবল মাত্র গলধঃকরণ করেছে। জিপসী তাকে এক বিস্ময়াষ্টি
দৃষ্টিতে জড়িয়ে ফেলে। ধোঁয়া ও দুর্গন্ধময় আলকাতরায় পরিণত হওয়ার আগমুহূর্তে তার দেয়া উত্তরের প্রতিধ্বনি
সেখানে ভাসসে থাকেঃ “মেলকিয়াদেস মারা গেছে”। এই খবরে কিংকর্ত্যববিমূঢ়
হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া অনড় হয়ে থাকে দুঃখটাকে হজম করার জন্য। ইতিমধ্যে ভীরটা হাল্কা
হতে শুরু করেছে অন্য কোন প্রদর্শনী দেখার জন্য আর মিতভাষী আর্মেনিয় সম্পূর্ণরূপে বাষ্প
হয়ে গেছে। আরও পরে অন্য জিপসীরা তাকে নিশ্চিত করে যে সত্যি মেলকিয়াদেস সিংগাপুরের বালির স্তুপে
হার মানে জ্বরের কাছে আর তার দেহ ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে জাভা সমুদ্রের সবচেয়ে গভীর জায়গায়। খবরটা বাচ্চাদের কাছে
কোনো গুরুত্ব পায় না। ওরা বাবাকে তাগাদা দিচ্ছে মেমফিসের বিজ্ঞদের বিস্ময়কর নতুনত্বের সঙ্গে পরিচয় করাতে। ঢোকার সময়েই তাবু থেকে
ঘোষণা করা হয়েছিলো সেটার মালিক ছিল রাজা সোলেমান। এত বেশি পীড়াপিরি করে ওরা যে হোসে আর্কাদিও
বুয়েন্দিয়া তিরিশ রিয়ালের বিনিময়ে তাবুর মাঝখানে প্রবেশ করে যেখানে লোমশ শরীর,
কামানো মাথা, নাকে তামার
নোলক, গোড়ালিতে ভারী শিকল বাঁধা এক বিশাল লোক পাহাড়া
দিচ্ছে জলদস্যুদের এক সিন্দুক। দৈত্যটা যখন সিন্দুকটাকে খোলে তখন ওটার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে
এক ঠান্ডা প্রবাহ। ওর ভেতর রয়েছে বিশাল স্বচ্ছ একটি টুকরো যাতে অগুনতি সূঁচ বসানো, এগুলো থেকে উষার নির্মলতায় বিক্ষিপ্ত হচ্ছে তারার মতো রং বেরঙের
উজ্জ্বলতা। বিচলিত, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া জানে যে বাচ্চাগুলো
অপেক্ষা করছে শিগগিরই এটার ব্যাখ্যা পাওয়ার জন্য, বুকে সাহস নিয়ে বিড়বিড় করলো সে:
- এটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হিরক খন্ড।
- না - জিপসী শুধরে দেয় - এটা বরফ।
না বুঝে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া হাত বাড়িয়ে
দেয় বরফের টুকরোর দিকে। কিন্তু দৈত্যটা হাত সরিয়ে দেয়, “ছোঁয়ার জন্য
আরও পাঁচ রেয়াল”– বলল। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তাই দিল। বরফের উপর হাত রাখল,
ওভাবেই রাখল কয়েক মিনিট আর ততক্ষণে তার বুক ভরে উঠছে ভয় আর রহস্যময়
স্পর্শের আনন্দে। কি বলবে বুঝতে না পেরে আরও দশ রিয়াল দিল যাতে কোরে বাচ্চারাও এই আশ্চর্য অভিজ্ঞতা
অনুভব করতে পারে। ছোট্ট হোসে আর্কাদিও ছুঁতে অস্বীকার করল। অন্যদিকে আউরেলিয়ানো এক পা বাড়িয়ে হাত রাখল
আর সরিয়ে নিল সঙ্গে সঙ্গে। “এটা বলকাচ্ছে”–চমকে গিয়ে বলল। কিন্তু ওর বাবার তাতে
মনোযোগ ছিল না। সেই সময়ে এই অত্যাশ্চর্যের প্রমাণে মাতাল সে ভুলে গেল তার ব্যর্থ পরিকল্পনার হতাশার
কথা আর স্কুইডের ক্ষিধের কাছে পরিত্যক্ত মেলকিয়াদেসের দেহের কথা। আরও পাঁচ রিয়াল দিয়ে
বরফের উপর হাত রেখে পবিত্র হরফ ছুঁয়ে সাক্ষ্য দেয়ার ভঙ্গিতে বললো- “এটা হচ্ছে আমাদের সময়ের মহান আবিষ্কার”।
পাঁচ ::
যখন জলদস্যু ফ্রান্সিস ড্রেক ষোড়শ শতকে রিওআচা
আক্রমণ করে তখন উরসুলা ইগুয়ারানের পরদাদী বিপদ ঘন্টা আর কামানের গোলার শব্দে দিশা হারিয়ে
জ্বলন্ত উনুনের উপর বসে পড়েছিল। সেই আগুনের ক্ষত তাকে করে দিয়েছিল সারাজীবনের জন্য এক অকর্মা
বউ। সম্পূর্ণভাবে বসতে
পারত না, বসত এক পাশে ভর করে, বালিশের সাহায্যে। তার হাটাচলায় অজ্ঞাত কিছু একটা ছিলো, যেকারণে সে আর কখনোই জনসম্মুখে হাটেনি। গা থেকে পোড়া গন্ধ বের হয়–এমন বদ্ধমূল ধারণা থাকায় সব ধরনের সামাজিক কাজ থেকে সে বিরত থাকে। ভোরবেলাটা আঙ্গিনায়
নির্ঘুম তাকে চমকে দিতো, কারন সে দুঃস্বপ্ন
দেখত যে ইংরেজরা তাদের হিংস্র কুকুরসহ জানালা দিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে উত্তপ্ত লাল লোহা
তার ভেতর লজ্জাজনকভাবে ঢুকিয়ে অত্যাচার করছে। স্প্যানিশ ব্যবসায়ী যে-স্বামীর ঔরসে দুই সন্তান
রয়েছে সে ঔষধপত্র আর আনন্দফূর্তির পেছনে দোকানের অর্ধেকটা ফতুর করে ফেলে স্ত্রীর ভয়
কাটানোর জন্য। সবশেষে ব্যবসা লাটে তুলে তাকে নিয়ে গেল সমুদ্র থেকে দূরে পাহাড়ের পাদদেশে এক নিরীহ
আদিবাসীদের লোকালয়ে, যেখানে বানালো স্ত্রীর জন্য এক শোবার ঘর,
ওটাতে এমন কোনো জানালা ছিল না যাতে করে তার দুঃস্বপ্নের জলসদ্যুরা
ঢুকতে পারে।
সেই গোপন লোকালয়ে অনেক আগে থেকে বাস করতো
দন হোসে আর্কাদি্ও বুয়েন্দিয়া নামের এক আদিবাসী তামাক চাষী যার সঙ্গে উরসুলার দাদীর
বাবা এমন এক লাভজনক অংশীদারি ব্যবসা গড়ে তোলে যে কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের ভাগ্য ফেরে।
কয়েক শতাব্দী পর সেই আদিবাসীর নাতির নাতি
বিয়ে করে স্প্যানিশ নাতনীর নাতনিকে। এর ফলে, প্রতিবার যখন স্বামীর
পাগলামী উরসুলাকে ক্ষিপ্ত করত তখন সে তিনশ বছরের ঘটনাচক্রের উপর ঝাপিয়ে পরতো,
শাপান্ত করত ফ্রান্সিস ড্রেকের বিয়োআচা আক্রমণের সময়টিকে। এটা ছিল শুধুমাত্রই
মনের ভার লাঘবের একটা উপায়, কারণ আসল কথা হচ্ছে
ওরা ছিল আমৃত্যু ভালবাসার চেয়েও শক্ত, অভিন্ন এক বিবেকদংশনে
বাধা। ওরা ছিল জ্ঞাতি ভাই
বোন। ওদের পূর্বপুরুষদের
শ্রম আর প্রথা দিয়ে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা প্রাচীন লোকালয়কে প্রদেশের সবচেয়ে ভালো গ্রামগুলোর
একটিতে পরিণত করেছিলো। যদিও যখন ওরা এই পৃথিবীতে আসে তখন থেকেই ওদের বিয়ে ছিল পূর্ব-নির্ধারিত। কিন্তু যখন ওরা পরস্পর
বিয়ের ইচ্ছে প্রকাশ করে তখন ওদের নিজেদের আত্মীয়রাই তাতে বাধা দেয়। ওদের ভয় ছিল যে দুই
বংশের এই স্বাস্থ্যবান জুটি বংশ পরস্পরায় নিজেদের মধ্যে উপর্যুপরি সংকরের ফলে ইগুয়ানার
ন্যায় সন্তান জন্ম দিয়ে লজ্জা পেতে পারে। এরকম একটা ভয়ংকর উদাহরণ আগে থেকেই ছিল। উরসুলার এক খালার বিয়ে হয়েছিল হোসে আর্কাদিও
বুয়েন্দিয়ার এক চাচার সঙ্গে, জন্ম দিয়েছিল এমন এক
ছেলের যে সারা জীবন ফুলানো ও ঢিলে প্যান্ট পরত আর মারা গিয়েছিল বিয়াল্লিশ বছর বয়সে
রক্তপাত হয়ে চিরকুমার অবস্থায়। কারন জন্ম নিয়েছিল আর বেড়ে উঠেছিল কোমলস্থির এক কুন্ডলীপাকানো
লেজ নিয়ে যার ডগায় ছিল বুরুষসদৃশ একগোছা চুল। শুকরের এক লেজ যা কিনা কখনোই কোন মেয়েকে দেখতে
দেয়নি। আর এই লেজের জন্য নিজের
জীবন দিতে হয়েছে কারণ যখন এক কসাই বন্ধু অনুগ্রহ করে হাড় কাটার কুঠোর দিয়ে কেটে দিয়েছিল
সেটি। লঘুমনস্ক উনিশ বছরের
হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া এই সমস্যার সমাধান করে দিলো একটি মাত্র বাক্যে “শুয়োরের ছানা হলেও কিছু আসে যায় না, যদি নাকি শুধু কথা বলতে পারে।” এভাবেই বিয়ে করল তিন দিনব্যাপী গানবাজনা আর আতশবাজীপূর্ণ উৎসবের
মধ্য দিয়ে । উরসুলার মা যদি সবসময় ওদের অনাগত সন্তানের ব্যাপারে অশুভ ভবিষ্যৎবানী না করতো,
এমনকি ওদের সহবাস না করার উপদেশ দেয়ার মত চরম পর্যায়ে না যেত
তাহলে ওরা সুখেই থাকত। শক্ত সামর্থ, স্বেচ্ছাচারী স্বামী ঘুমের মাঝে ধর্ষণ করতে
পারে–এই ভয়ে উরসুলা শোবার সময় ওর মার হাতে তৈরি প্রাচীনকালের প্যান্ট
পড়তো যেটাকে মজবুত করা হয়েছিলো এক ধরনের ফিতে আড়াআড়ি তার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে যেটা বন্ধ
করা যেত সামনের দিক থেকে খুব মোটা লোহার বক্লেস দিয়ে। এভাবেই কাটালো কয়েক মাস। দিনের বেলাটা কাটতো
লড়াইয়ের মোরগগুলো দেখাশুনা করে আর মায়ের সঙ্গে ফ্রেমে এমব্রয়েডারি করে। আর রাতের বেলা কাটাত
ঘন্টা কয়েক ব্যগ্র, তীব্র উত্তেজনাময় জোরাজুরি করে যেন সেটা ছিল
যৌনমিলনের বিকল্প। এই অবস্থা চলতে থাকে যতক্ষন না জনপ্রিয় স্বজ্ঞা গন্ধ পেয়ে যায় যে অস্বাভাবিক কিছু
একটা ঘটছে আর গুজব ছড়িয়ে পরে যে বিয়ের এক বছর পরও উরসুলা হচ্ছে কুমারী, কারণ তার স্বামী একটা নপুংসক। গুজবটা সর্বশেষ যে ব্যক্তির কানে গিয়ে পৌঁছোয়
সে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া।
–দেখছিস উরসুলা, লোকজন কী বলছে,–স্ত্রীকে বলল খুব শান্তভাবে।
–ওদের বলতে দাও– উত্তর দিল–আমরা জানি ওটা সত্য নয়।–
অবস্থাটা এরকম থাকলো আরও ছয় মাস, অবশেষে এক করুণ রোববারে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া জেতে এক মোরগ
লড়াই প্রুদেন্সিও আগিলারের সঙ্গে। ক্রোধনোমত্ত, পাশবিক উত্তেজনায়
হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার কাছ থেকে খানিকটা দূরে সরিয়ে নিলো নিজেকে যাতে সমস্ত গ্যালারি
শুনতে পায় যা সে বলতে চায়।
–তোকে অভিনন্দন-চিৎকার করল,– দেখা যাক শেষ পর্যন্ত এই মোরগ তোর বউয়ের কাজে লাগে কিনা। শান্ত হোসে আর্কাদিও
বুয়েন্দিয়া নিজের মোরগটা তুলে নিল। “এখনই ফিরে আসছি” সবাইকে উদ্দেশ্য
করে বললো। পরে প্রুদেন্সিও আগিলারকে লক্ষ করে বলে: “আর তুই বাড়ি যা, অস্ত্র নিয়ে তৈরি হ, কারণ তোকে মেরে ফেলবো।” মিনিট দশেক পর দাদার ধারালো বল্লম নিয়ে সে
ফিরে আসে। মোরগ লড়াইয়ের যে-জায়গাটায় গ্রামের অর্ধেক লোক জড়ো হয়েছিলো, প্রুদেনসিও আগিলার সেখানেই অপেক্ষা করছিল। আত্মক্ষার সময়ও পেল
না, প্রথম আ্রউলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যে-নিশানা দিয়ে এলাকার বাঘগুলিকে
শেষ করেছিলো ঠিক সেই রকম নিশানা আর ষাড়ের মত শক্তি দিয়ে বল্লমটাকে সে এমনভাবে ছুঁড়ে
মারলো যে তা গলা ভেদ করে বেড়িয়ে গেল। সেই রাতে যখন মোরগ লড়াইয়ের জায়গায় লাশটার অন্তেষ্টিক্রিয়া হচ্ছে,
হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ঢুকল শোবার ঘরে, ওর বউ তখন শাস্তির প্যান্টটি পরছে । “ওটা খোলা”, আদেশ করল। উরসুলা স্বামীর সিদ্ধান্তে কোন সন্দেহ প্রকাশ করল না।-যা ঘটবে তার জন্য তুমি দায়ী থাকবে। ফিসফিস করলো। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া
বল্লমটা মাটিতে পুতলো।
যদি উগুয়ানারই জন্ম দা্ও, ইগুয়ানাই লালন করব- বলল -কিন্তু তোমার দোষে এই গ্রামে আর কেউ
মারা যাবে না।
এটা ছিল জুনের এক সুন্দর চাঁদে ভরা ঠান্ডা
রাত, জেগেছিল সকাল হওয়া পর্যন্ত বিছানায় লুটোপুটি করে আর অন্যদিকে
যে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল শোবার ঘরের ভিতর দিয়ে তা ছিল প্রুদেন্সিও আগিলারের আত্মীয়দের
কান্নায় ভারী।
ঘটনাটা বিবেচিত হয়েছিল সম্মান রক্ষার দ্বন্দযুদ্ধ
হিসেবে, কিন্তু ওদের বিবেকের মধ্যে একটা অস্বস্তি
থেকেই যায়। এক রাতে ঘুমুতে না পেরে, উরসুলা উঠোনে পানি
পান করতে যায় আর দেখতে পায় প্রুদেন্সিও আগিলারকে কলশির পাশে। ওকে পান্ডুর দেখাচ্ছিলো, অভিব্যক্তি ছিল খুবই করুণ, গলার গর্তটাকে খড় দিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করছে। ওকে দেখে উরসুলার মনে ভয়ের বদলে করুণারই সৃষ্টি
হলো। ঘরে ঢুকে স্বামীকে
বলল যা দেখেছে, কিন্তু সে পাত্তা দিল না। “মৃতেরা বেরিয়ে আসে
না” বলল, “ঘটনা হলো আমরা বিবেকের
দংশন সহ্য করতে পারছি না।” দু’রাত পর, উরসুলা আবার দেখতে পেল প্রুদেন্সিও আগিলারকে গোসলখানায়;
গলায় জমাট বাঁধা রক্ত পরিস্কার করছে খড় দিয়ে। আরেক রাতে দেখল বৃষ্টির
মধ্যে সে হেঁটে বেড়াচ্ছে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বৌয়ের অলীকদর্শনে উত্যক্ত হয়ে বল্লম
নিয়ে উঠোনে বের হলো। ওখানেই ছিল প্রুদেন্সিও আগিলার তার করুণ অভিব্যক্তি নিয়ে।
- জাহান্নামে যা - চিৎকার করল হোসে আর্কাদিও
বুয়েন্দিয়া, –যতবার ফিরে আসবি ততবারই তোকে মেরে ফেলব।
মূল বইয়ের পাচ পর্বের সংক্ষিপ্ত বর্ননা খুব ভাল লাগল। বাকী পর্বগুলো পাবো কী?
উত্তরমুছুন